চন্ডীমঙ্গল কাব্যের মুরারী শীল (Murari-Shil) চরিত্র সম্পর্কে আলোচনা - pdf
বাংলা সাহিত্যে চন্ডীমঙ্গল কাব্যে আমরা কিছুটা স্বতন্ত্রতা লক্ষ্য করতে পারি। যে সকল চরিত্র গুলি কবি এই কাব্যে তুলে ধরেছেন তার মধ্যে আমরা ভারু দত্ত সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজ এখানে আমরা চন্ডীমঙ্গল কাব্যের মুরারী শীল (Murari-Shil) চরিত্র টি সম্পর্কে আলোচনা করলাম -
মুরারী শীল চরিত্র
কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যের একটি ব্যতিক্রমী অসাধারণ চরিত্র মুরারী শীল। মুরারী চরিত্রের বাস্তবতা কবিকঙ্কণকে আধুনিক সাহিত্যের প্রবেশপথের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। কারণ উপন্যাসে যে বস্তুনিষ্ঠ নিরপেক্ষ সজীব চরিত্র চিত্রণের দায়বদ্ধতা থাকে উপন্যাসিকের, সেই দায়বদ্ধতা নিয়ে মুকুন্দ রচনা করেছেন মুরারী শীলকে।
পর্যবেক্ষণের দুটি শক্ত-পোক্ত পা ছিল বলেই কবি সমাজের অভ্যন্তর থেকে, রক্তমাংস মেদবর্ণ সমেত বিকৃতভাবে চরিত্রটিকে সাহিত্যে তুলে আনতে পেরেছেন। মুরারীকে ষোড়শ শতকের সমাজ পরিবেশে খুঁজলে যেমন মিলত, তেমনি একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক জগতেও তার দেখা পাওয়া সম্ভব। মানুষ যে কত শঠ, লোভী আর স্বার্থপর হতে পারে তার পরিচয় পাওয়া যায় মুরারী শীলের চরিত্রে।
![]() |
Educostudy.In/Murari-Shil |
মুরারী শীল সমগ্র কাব্য জুড়ে আপন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। সে লোভী বণিকসমাজের প্রতিনিধি। সে ধূর্ত, অভিনয় পটু, প্রবঞ্চক ও প্রত্যুৎপন্নমতি। তার পরিচয় দিতে গিয়ে মুকুন্দ বলেছেন –
“বাণ্যা বড় দুঃশীল নামেতে মুরারী শীল
লেখা-জোখা করে টাকাকড়ি।”
তাই যেদিন কালকেতু তার সোনার আংটিটা মুরারীর কাছে বিক্রি করতে এসেছিলসেদিন কালকেতুর কণ্ঠস্বরে সে পাওনা টাকা দেবার ভয়ে লুকিয়ে পড়ে অন্দরমহলে। উত্তমর্ণকে প্রতিহত করার জন্য মঞ্চে উপস্থিত থাকে বণিকের সুযোগ্যা সহধর্মিণী। বেনেনী জানালো –
“ঘরেতে নাহিকো পোত্দার
প্রভাতে তোমার খুড়া গিয়াছে খাতক পাড়া
কালি দিব মাংসের উধার।।”
কিন্তু কালকেতু যখন জানালো সে একটি অঙ্গুরী বিক্রি করতে এসেছে খুড়ার কাছে, পাওনা নিতে নয়, তখন প্রাপ্তিযোগের গন্ধ পেয়ে পিছনের দরজা দিয়ে মুরারী হাজির হয়ে স্বজাতীয় বৈশিষ্ট্যে অন্তরঙ্গ সুরে বাক্যালাপ করে –
“বাণ্যা বলে ভাইপো ইবে নাহি দেখি তো
এ তোর কেমন ববহার।।”
তারপর যখন কালকেতু আংটি প্রসঙ্গ তুলল তখনই আংটিটি দেখেই ধূর্ত মুরারী বুঝতে পেরেছে যে এই অশিক্ষিত ব্যাধ আংটিটির প্রকৃত মূল্য জানে না। সুতরাং সঙ্গে সঙ্গে তার স্বার্থপর প্রবৃত্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। সে বলেছে –
“সোনা রূপা নহে বাপা এ বেঙ্গা পিতল
ঘষিয়া মাজিয়া বাপু কর্যাছ উজ্জ্বল।”
ব্যাধ অশিক্ষিত হয়েও তার জীবনে সম্পদ পেতে যাচ্ছে অথচ মুরারী বণিক হয়েও সে সম্পদ পাচ্ছে না, এরকমই এক পরিস্থিতিতে যখনই সে সম্পদ তার হস্তগত হয়েছে তখনই তার লোভ তাকে প্রতারক করে তুলেছে।
কিন্তু কালকেতুর বৈষয়িক বুদ্ধির কাছে মুরারী ধাক্কা খেল। মুরারীর চাতুর্য বুঝতে পেরেছে কালকেতু –
“কালকেতু বলে খুড়া মূল্য নাহি পাই
যে জন দিয়াছে ইহা তাঁর ঠাই যাই।”
মুরারী এই দামী আংটিটি হাতছাড়া করতে চায় না। তাই সে বাক্-কৌশল অবলম্বন করে ববসায়িক সাধুতার কথা ঘোষণা করে –
“বাণ্যা বলে দরে নাহি বাড়ে এক বট।
আমা সনে সওদা কৈলে না পাবে কপট।”
আবার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের সুড়সুড়ি দিয়ে কালকেতুর অতিরিক্ত বিষয়বুদ্ধির জন্য মৃদু ভর্ৎসনার সুরে বলেছে –
“ধর্মকেতু ভায়া সনে কৈলুঁ লেনাদেনা।
তাহা হৈতে ভাইপো হয়্যাছে সেয়ানা।।”
স্বার্থপর নাছোড়বান্দা বেনেকে বাধ্য হয়ে দেবী চণ্ডী আকাশবাণী প্রেরণ করেন সবার অলক্ষ্যে –
“অকপটে সাতকোটি তঙ্কা দেহ বীরে।
বাড়িবে তোমার ঘর চণ্ডীকার বরে।”
ফলে ভীতু বাঙালী মুরারী কালকেতুকে ডেকে বলে –
“এতক্ষণ পরিহাস করিলাম তোমারে।।”
এখানেই বোঝা যা মুরারী ধর্মভীরু বাঙালী। সে প্রতারক, ধূর্ত। সে প্রথম দিকে স্বার্থপরতার জন্য দৈব বাণীকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে দেবীর স্বপ্নাদেশে ভয় পেয়ে গেছে। স্বার্থের সংঘাত আছে কিন্তু দেবতার বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি নেই। সে প্রতি মূহুর্তে অদৃষ্ট মানে, অলৌকিকতাকে বিস্বাশ করে, সংস্কারের দাসত্ব করে।
আসলে বস্তুনিষ্ঠ পন্থা মুকুন্দের সময়ে যুগোচিত সাহিত্যধর্ম ছিল না, ওটা তাঁর একান্ত স্বকীয় ধর্ম। অগোচরে তাঁর কলমকে স্বধর্ম পরিচালিত করেছিল বটে কিন্তু যখনই তিনি সচেতন হয়ে উঠেছেন তখনই যুগধর্ম প্রবল হয়ে উঠেছে, বস্তুনিষ্ঠা আদর্শনিষ্ঠায় বিলীন হয়েছে, নির্মমতার স্থলে তন্ময়তা দেখা দিয়েছে।
মুরারী চরিত্রের মধ্য দিয়ে অতি সাধারণ স্তরের একটি কপট বণিকবৃত্তিকে লক্ষ করা যায়। সে ভাঙে তবু মচকায় না। তার এই চরিত্রকে আরো অনবদ্য করে তুলেছে স্ত্রীর সাহচার্য, বাক্যবিনাসের পটুত্ব এবং কৌতুকরসের সহযোগ। ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য মুরারীর এর ধূর্ততা দেখে তাকে ‘শাইলক’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন।
এটাই মুকুন্দের স্বাতন্ত্র্য। মুকুন্দরাম ঔপন্যাসিক ছিলেন না। তবুও তাঁর পর্যবেক্ষণের দুটি পা ছিল বলেই তিনি বাস্তব থেকে মুরারী শীলকে তুলে এনেছেন সাহিত্যের জলসায়। সে মুরারী সংসারে সহজপ্রাপ্য জীব, সে সুযোগ পেলেই দুর্বল মানুষকে টকাতে চা আবার বিপদে পড়লে নামাবলী গায়ে জড়িয়ে দেবতার পাদপীঠে নতজানু হয়।
মুরারীর মধ্যে তাই প্রকাশ অএয়েছে মধ্যযুগীয় আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থগৃধ্নুতা এবং অলৌকিক সংস্কারবাদ। আর এর প্রকাশক মুকুন্দরামের হাতেই প্রথম ঔপন্যাসিকের রাজচিহ্ন লক্ষ করা যায়। মুরারী শীল সে প্রতিভারই উল্লেখযোগ্য স্মারক।
👉👉 বাংলা সাহিত্যের প্রায় সকল গুরুত্ব পূর্ণ প্রশ্ন নিয়ে আমরা এখানে আলোচন করছি, আজ আমরা এখানে চন্ডীমঙ্গল কাব্যের অন্যতম শঠ চরিত্র মুরারী শীল সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এছাড়াও অন্যান্য প্রশ্ন ও উত্তর গুলির জন্য উপরে দেওয়া লিংক টি তে ক্লিক করতে পারেন।।
Comments
Post a Comment