শাক্ত পদাবলীর কবি কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের কবিকৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা - আগমনী ও বিজয়া

   বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগে গীতিকবিতার ঊষালগ্নে জন্ম হয়েছিল শাক্ত পদাবলীর। এই শাক্তপদাবলী ধরার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কমলাকান্ত ভট্টাচার্য (Kamalakanta-Chakrabartee)। আজ আমরা এখানে কবি কমলাকান্ত ভট্টাচার্য সম্পর্কে ও তার কবি কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করব। আমরা এর আগে সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন সম্পর্কে আলোচনা করেছি। 




কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের কবিকৃতিত্ব

অষ্টাদশ শতাব্দীর অন্ধকারাচ্ছন্নকালে, বিশ্বমাতার দৃষ্টিবিভ্রমকারী রহস্য-সঞ্চারী রূপে তন্ময় কবি কমলাকান্তের আবির্ভাব। যে কালে রাজনৈতিক দূর্বিপাকে জাতীয় জীবন নানা অপমানে নিষ্পেষিত, হতাশা ও নৈরাশ্যের অতল গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল মানবাত্মা, সেই কালে কমলাকান্ত বাঙালীর সামনে তুলে ধরেছিলেন এমন এক মাতৃসাধনালব্ধ বাণী যা তৎকালীন জীবনে অনিশ্চিত দুর্ভাগ্যের উপর শান্তির প্রলেপ দিতে পেরেছিল।

কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের কবিকৃতিত্ব
Educostudy.In/Kamalakanta-Chakrabartee


  কমলাকান্তের কল্পিত মাতৃমূর্তির মধ্যে ফুটে উঠল সমস্ত দেশ-কালের এক বিপর্যস্ত চেহারা। তাঁর মাতৃমূর্তি রিক্তভূষণা ও রক্তাম্বরা তাঁর সৌন্দর্য ভক্তের মনোবাঞ্ছায় হয়ে উঠল অনিন্দ্যকান্তি। তাই এক সর্বরিক্তকালের ধূসর তটরেখায় দাঁড়িয়েও কবি কমলাকান্ত শান্তির নীড় খুঁজে দিয়েছেন জাতিকে। একথা ঠিক কমলাকান্ত কবি প্রতিভায় রামপ্রসাদের সমগোত্রীয় ছিলেন না, কিন্তু তবুও তাঁর পদে ফুটে উঠেছে যুগসন্ধির বিলাপগীতি।




কমলাকান্ত মুগ্ধ দৃষ্টিতে বিশ্বজননীর অনন্ত প্রতিমা নিরীক্ষণ করেছেন। তাই তাঁর আগমনীর গানে বাঙালীর গৃহাঙ্গনের মৃত্তিকালগ্ন পরিচিতি ফুটে উঠেছে। যখন কমলাকান্তের এই গানগুলি রচিত হয়, তখন কৌলীন্যপ্রথার যূপকাষ্ঠে বাঙালী মা-বাবা তাদের অল্পবয়সী কন্যাকে বলি দিতে বাধ্য হত। ফলে উদ্ভ্রান্ত দুটি দৃষ্টি নিয়ে মা-বাবাকে অপেক্ষা করতে হত বৎসরান্তে কন্যার বারেক প্রত্যাবর্তনের দিনটির জন্য।


 কমলাকান্তই প্রথম বাংলার পর্ণকুটীরবাসী বাবা-মার গার্হ্যস্হ উৎসবের এই করুণামধুর পরিবেশটিকে গিরিরাজ-মেনকা আর হর-পার্বতীর কাহিনীর পৌরাণিক স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে লৌকিক জীবনের আনন্দ বেদনায় স্থাপিত করেছে। নৈশ স্বপ্নে উমার মুখখানি দেখে কন্যাব্যাকুলা জননী মেনকা কাতরা বাঙালী জননীর মতই উৎভ্রান্ত হয়ে উঠেছে-




“আমি কি হেরিলাম নিশি-স্বপনে।
গিরিরাজ অচেতনে কত না ঘুমাও হে।
এই এখনি শিয়রে ছিল, গৌরী আমার কোথা গেল হে
আধ-আধ মা বলিয়ে বিধু বদনে।”


   ত্রিভুবনেশ্বরী মহাশক্তিরূপিনী উমা মাতার কাছে চিরদিনই অসহায় পরগৃহবাসিনী বালিকামাত্র। তাই স্বপ্নে সেই কন্যারূপখানি দেখে মায়ের স্নেহ ওঠে ঢেউ খেলিয়ে। যদিও কমলাকান্ত জ্ঞানদৃষ্টিতে জানেন, এই কন্যাই ভুবনমোহিনী জগন্মাতা। তাই পদান্তে তিনি বলেছেন-




“ও পদপঙ্কজ লাগি শঙ্কর হৈয়েছে যোগী গো
হর হৃদি-মাঝে রাখে অতি যতনে।”


তবুও মাতৃ-হৃদয়ের উদ্বেগ ব্যাকুলতার অন্ত নেই। তাই প্রভাতের অরুণোদয়ে মাতার হৃদিমুকুরে স্বপ্নভ্রষ্ট ক্ষণদৃষ্ট উমার অকলঙ্ক বিধুমুখ খানির স্মৃতি এবং পিতার নিষ্ঠুর ঔদাসীন্যের জন্য গঞ্জনা প্রকাশিত হয়েছে-


“কাল স্বপনে শঙ্করী-মুখ হেরি কি আনন্দ আমার
হিমগিরি হে, জিনি অকলঙ্ক বিধু, বদন উমার।”


স্বপ্ন কেবল স্মৃতিভাণ্ডার উদ্ঘাটিত করে না, উদ্বিগ্ন জননীর কাছে এই স্বপ্ন রূপান্তরিত বাস্তবই বটে। তাই মাতৃচিত্ত আধো-আধো ভাষিণী উমার মুখে অকস্মাৎ অভিমান আবিষ্কার করেছে-




“ওহে গিরিরাজ! গৌরী অভিমান করেছে
মনোদুঃখে নারদে কত না কয়েছে।”


মা ভেবেছে, কত দুঃখ, কত লাঞ্ছনা না উমাকে সইতে হয়। সতীনের জ্বালা, স্বামীর অসৎ চরিত্র কন্যাকে ভিখারিণী করে তুলেছে। কন্যার পারিবারিক গোলযোগের সম্ভাব্য সূত্রগুলি কল্পনা করেছে মা-


“হরের বসন বাঘছাল, ভূষণ হাড়মাল জটায় কালফণী দুলিছে
শিবের সম্বল ধুতুরারই ফল, কেবল তোমারই মন ভুলেছে।”


অবশেষে বিপন্ন মাতা অনুরোধ করেছে গিরিরাজকে-




“কবে যাবে বল গিরিরাজ গৌরীরে আনিতে
ব্যাকুল হইয়াছে প্রাণ উমারে দেখিতে হে।”


এরপর ভগ্ন গৃহভিত্তির কোণে যখন কন্যার আলতারাঙা চরণদুখানি এসে থামত, তখন হতভাগ্য পিতা-মাতার নিরুল্লাস নিলয়ে সারা বৎসর যে প্রবাসিনী কন্যার স্মৃতি ভেসে বেড়াত একদিন শরৎ পঞ্চমীর স্বর্ণপ্রভাতে তা যেন সত্য হয়ে উঠত। এই সময় কন্যা তার মায়ের কাছে স্বামীর ঐশ্বর্যের কথা শোনাত আর মায়ের সব দুঃখ দূর হয়ে যেত-


“শরৎ কমল মুখে, আধো আধো বাণী মায়ের
মায়ের কোলেতে বসি শ্রীমুখে ঈষৎ হাসি
ভবের ভবন সুখ ভণয়ে ভবাণী।”


আগমনীর এই উচ্ছ্বাস বিজয়ার বীণাযন্ত্রে বেদনার রাগিনী বাজিয়ে দেয়। নবমীর নিশি চলে যাবে চারদিনের আনন্দ-হাট ভেঙে দিয়ে তাই মায়ের কণ্ঠে শোনা যায় নিশ্চিত পলাতক রাত্রিকে ধরে রাখার এক করুণ মিনতি-




“ওরে নবমী নিশি না হইও রে অবসান
শুনেছি দারুন তুমি না রাখ সতের মান।”


কিন্তু শেষ পর্যন্ত নবমী নিশি অবসিত হয়, উমার বিদায়ের জন্য বিসর্জনের বাজনা আকাশ আকুল করে তোলে। জামাইকে হাজার বোঝানো সত্ত্বেও সে বোঝে না। মা জামাইয়ের ঐশ্বর্য বোঝে না। সে কেবল নিজের সোনার পুতুল কন্যাকে বুকে ধরে রাখতে চায়-


“আমার গৌরীরে লয়ে যায় হর আসিয়ে
কি কর হে গিরিবর রঙ্গ দেখ বসিয়ে।”


আগমনী মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত বাঙালী সমাজের “যেতে নাহি দিব” বিজয়া সেই সমাজের “তবু যেতে দিতে হয়।”




প্রত্যক্ষভাবে রামপ্রসাদের পদ এবং পরোক্ষভাবে বৈষ্ণবীয় পদাবলীর উত্তরাধিকারেই কমলাকান্তের পদগুলির পরিপুষ্টি। কমলাকান্ত পদলালিত্যে, শব্দ ব্যবহারে ও ভাষা ব্যবহারে বৈষ্ণব পদাবলীর অনুসরণ করেছেন। তিনি যেন শ্মশানবাসিনী, বৈপরীত্য-ছন্দ-বিলাসিনীর রক্ত রঞ্জিত চরণে বৈষ্ণবীয় কাব্য সাধনার নূপুর পরিয়ে দিয়েছেন।


 কিন্তু তবুও কমলাকান্তের গান সংসারের তীব্র সংকটে ও আশাভঙ্গের বেদনায় মাতৃচরণকে মুক্তির তীর্থরূপে দেখিয়েছেন। তাই মায়ের রাঙা পায়ের তলায় অর্পিত কমলাকান্তের গানগুলি শতদলের মত কোরক বিস্তার করেছে। শতাধিক বর্ষ শেষেও তার বর্ণে আর গন্ধে আমরা বিহ্বল, প্রণত।





আগমনী ও বিজয়ার পদে পারিবারিক ও গার্হ্যস্থ চিত্র

আগমনী ও বিজয়ার পদগুলিতে বাঙালীর পারিবারিক জীবনের সুখ-দুঃখের কথা অতি করুণ ও মধুর রাগিনীতে বেজে উঠেছে। আগমনী বিজয়ার পদগুলি গার্হ্যস্থ বাৎসল্যের একটি সকরুণ নাট্যরূপ। পরের ঘরে প্রেরিত কন্যাকে শরৎ নিশি শেষে জননীর স্বপ্নে দেখা মুহূর্ত থেকে এই লীলা নাট্যের সূচনা।


  তারপর কন্যাকে একবার চোখে দেখার উদ্বেগ এবং শেষ পর্যন্ত চারদিন পরে মেনকাকে শোক-সাগরে নিক্ষিপ্ত করে উমার আবার পতি গৃহে যাত্রা-এখানেই এই সংসার স্নেহ নাটিকাটির যবনিকাপাত। পৌরাণিক প্রসঙ্গের সূত্র রক্ষা করে এই গুলির ভিতর দিয়ে গার্হ্যস্থ ও পারিবারিক জীবনের চিরন্তন ক্রন্দনকে মূর্ত করেছেন শাক্ত কবিরা। তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-


“হরগৌরীর কথা আমাদের ঘরের কথা। সেই হরগৌরীর কথায় আমাদের বাংলাদেশের একটা বড় মর্মের কথা আছে। কন্যা আমাদের গৃহের এক মস্ত ভার।----হরগৌরীর কথা বাংলার একান্ন পরিবারের সেই প্রধান বেদনার কথা।”




অষ্টাদশ শতাব্দীতে সমাজের নিষ্ঠুর বিধি-বিধানে ও কৌলীন্য প্রথার যূপকাষ্ঠে পিতা-মাতার কন্যাকে বলি দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। ফলে দরিদ্র, উদাসীন, বাউন্ডুলে পাত্রের হাতে পড়ে কন্যাকে দুঃখের কলে নিষ্পেষিত হতে হত।


 বাঙালী কবিরা হিমালয়-মেনকা, হর-গৌরীর পৌরাণিক কাহিনীতে এই একই সমস্যাকে কাজে লাগিয়েছেন নিজস্ব কাব্য সাধনায়। আগমনী বিজয়ার সঙ্গীতের উৎস তাই কৈলাস বা হিমালয়পুরী নয়। প্রতি গৃহস্থের হৃদয় যেন এই সঙ্গীতের গঙ্গোত্রী। তাই ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন-


“এই পদগুলিতে বাংলাদেশের মায়েদের প্রাণের কথা বড় আন্তরিক করুণ সুরে ধরা পড়িয়াছে। (বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, তৃতীয় খণ্ড, দ্বিতীয় পর্ব, পৃষ্ঠা-২৯৬)


বাঙালী পিতা-মাতার কন্যার জন্য দুঃখ-বিদীর্ণ হৃদয়ের কথা আরম্ভ স্বপ্ন দিয়ে। প্রতি বৎসর শরৎকালে ভোরের বাতাস যখন শিশির সিক্ত এবং রৌদ্রের রঙ কাঁচা সোনার মত, তখন গিরিরাণী সহসা একদিন শ্মশানবাসিনী সোনার গৌরীকে স্বপ্নে দেখেন-




“আমি কি হেরিলাম নিশি স্বপনে
গিরিরাজ, অচেতনে কত না ঘুমাও হে
এই এখনই শিয়রে ছিল গৌরী আমার কোথা গেল হে।”


এ স্বপ্ন গিরিরাজ আমাদের পিতামহ এবং প্রপিতামহদের সময় থেকে ললিত-বিভাস এবং রামকেলী রাগিনীতে শুনে আসছেন। কিন্তু প্রতি বৎসরই নতুন করে শোনেন। এরপর মেনকার মুখে বাঙালী জননীর চিরকালীন বাসনার কথা ব্যক্ত হয়েছে-


“গিরি, এবার উমা এলে, আর উমা পাঠাব না
বলে বলবে লোকে মন্দ, কারও কথা শুনব না।"




আনমনা মায়ের মন কন্যার পারিবারিক গোলযোগের সম্ভাব্য সূত্রগুলি কল্পনা করে বেদনায় কাতর হয়ে উঠেছে। তাই কন্যার চিন্তায় কেঁদে ওঠে মায়ের মন- “না জানি মোর গৌরী আছে কেমনে।” কমলাকান্তের একটি পদে আঠারো শতকের বাঙালী মায়ের প্রতিনিধি হয়ে মেনকা জানালেন তাঁর কন্যার সুখে না থাকার কারণ-


“একে সতীনের জ্বালা না সহে অবলা যাতনা প্রাণে কত সয়েছে
তাহে সুরধনী, স্বামী সোহাগিনী সদা শঙ্করের শিরে রয়েছে।”


তাই স্বামী হিমালয়ের কাছে কন্যাকে বাড়ীতে আনার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে-




“বৎসর গত হয়েছে কত করেছে শিবের ঘর
যাও গিরিরাজ আনিতে গৌরী কৈলাস শিখর।”


এরপর সব দুঃখের অবসান করে শরতের রৌদ্র-শিশিরে ঝলমল, শিউলি ফুলের গন্ধে ভরা মাতা-পিতার গৃহ-প্রাঙ্গনে কন্যা তার আলতারাঙা চরণদুখানি নিয়ে হাজির হত। মায়ের সঙ্গে প্রতিবেশীরা তখন কন্যাকে বরণ করে নিতে যায়-


“আমার উমা এল বলে রাণী এলোকেশে ধায়
যত নগর নাগরী সারি সারি দৌড়ি গৌরী মুখপানে চায়।”




কিন্তু এত আনন্দের মধ্যেও মায়ের মন কোনও একটি বেদনায় চমকে চমকে ওঠে। কারণ এই আনন্দ শুধুমাত্র তিনদিনের। তারপরই নবমী নিশি বিদায়ের হাতছানি দেয়। তাই নিশ্চিত পলাতক রাত্রিকে ধরে রাখার জন্য মায়ের এক করুণ মিনতি প্রকাশ পেয়েছে-


“ওরে নবমী নিশি না হইও রে অবসান
শুনেছি দারুন তুমি না রাখো সতের মান।”


কিন্তু তবুও নবমী নিশির অবসান হয়। দশমীর প্রভাতের সূর্যের কিরণ বিদায়ের বেদনায় আকুল হয়ে পড়ে। আগমনীর “যেতে নাহি দিব” বিজয়ার প্রভাতে পরিণত হয় “তবু যেতে দিতে হয়”-এই বাণীতে।




আগমনী বিজয়ার গানগুলি বাঙালীর মাতৃস্নেহকাতর গৃহপ্রাঙ্গনে প্রভাতের আলোয় আনন্দের কমলখানি ফুটিয়ে তোলার ও ঝরিয়ে দেওয়ার লীলা সূত্রে বাঁধা। আগমনী বিজয়ার পদগুলিতে ধর্মীয় বা পৌরাণিক পটভূমি ম্লান হয়ে গেছে, ব্যক্ত হয়েছে বাঙালীর দৈনন্দিন জীবনের তুচ্ছতার চিত্রের মধ্যেও অনাবিল আনন্দের মধুর সুন্দর প্রাণস্পর্শী সঙ্গীতধর্মীতা।


 গিরিরাজ মেনকা আমাদের বাঙালী ঘরের পিতামাতা। যাদের চিনে নিতে আমাদের তিলমাত্র বিলম্ব হয় না। কৈলাসপুরী ও শিবপুরী-দুটি সংসারের গৃহস্থালী, হাসি-কান্না, মান-অভিমান, দম্পতির রহস্যালাপ, সন্তানের জন্য মাতৃ-হৃদয়ের ব্যাকুলতা ইত্যাদি বিষয়কে কেন্দ্র করে আগমনী বিজয়ার পদগুলি উদ্বেলিত। তাই আগমনী বিজয়ার পদগুলিতে পৌরাণিক আখ্যায়িকা বাঙালী জননীর অশ্রুজলে অভিষিক্ত হয়ে বস্তুজগতের পারিবারিক ও গার্হ্যস্থভাবে পূর্ণ হয়ে উঠেছে।





শাক্ত পদাবলীর সমাজচিত্র

সাহিত্য হল সমাজের দর্পন। সমাজ থেকে উপাদান সংগ্রহ করেই সাহিত্যের স্বর্ণচূড়া গগনস্পর্শী হয়। কোনও লেখক যে সমাজে বসে সাহিত্য রচনা করেন, সেই সমাজকে তিনি উপেক্ষা করতে পারেন না। সমাজের বাস্তবচিত্রই লেখকের লেখনীর মধ্যে দিয়ে সাহিত্যের পৃষ্ঠায় কালো অক্ষরে পরিণত হয়।


  সাহিত্যের বুকে অনুসন্ধানের লগি ফেলে জানা যায়, কোনও একটি সমাজের বিভিন্ন স্তরের গভীরতা। তাই সমাজের বিভিন্ন চিত্র সাহিত্যের পায়ে নূপুরের মত ঝঙ্কিত হয়ে থাকে। জীবনের বহু-প্রকাশই সাহিত্য। এপসঙ্গে সমালোচক হাডসন বলেছেন-


“We care for literature primarily on its deep and lasting human significance.”




মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে শাক্ত পদাবলীর মধ্যে জীবনের এই বহু বিচিত্র রাগ-রাগিনী অনন্য সুরমূর্ছনায় বেজে উঠেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে রচিত গীতিপদাবলীগুলিতে বাংলার তৎকালীন দুর্দশাগ্রস্থ ভগ্নগৃহের সূবর্ণমণ্ডিতা জননীর স্বল্প ক’দিনের আগমন ও বিদায়ের সঙ্গে বাঙ্গালীর কন্যা-বিবাহ-ঘটিত পুরাতন ইতিহাস একটি বিষণ্ণ সাদৃশ্যে গাঁথা হয়ে দেখা দিল। অন্যদিকে নির্যাতিত সমাজ ব্যবস্থার অন্ধকার প্রেক্ষাপটে অসহায় মানুষের করুণ জীবনচর্চাই শাক্ত সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন হিসাবে প্রকাশিত হল।


শাক্ত পদাবলীর উমা-মহেশ্বর ও গিরিরাজ-মেনকা বাংলার সমাজ জীবনের গৃহস্থ সংসারের টিপিক্যাল মেয়ে-জামাই, কর্তা-গিন্নি হয়ে উঠেছে। দেবচরিত্রের এই মানবায়ন সেকালের সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের ফসল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলার মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত জনগণ মুখোমুখি হয়েছিল এক চরমতম রাষ্ট্রিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কতকগুলি আচার সর্বস্ব প্রথা-

কৌলিন্য প্রথা,
বহুবিবাহ প্রথা
সহমরণ প্রথা
বাল্যবিবাহ প্রথা
সতীন কোন্দল প্রথা।

এগুলি তৎকালীন সমাজের শোকাবহ নিদর্শন।




উমার বিবাহ প্রসঙ্গে শাক্ত পদকর্তাগণ দেখিয়েছেন উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান না পেয়ে মা-বাবাকে ব্যবসায়ী ঘটকের দারস্থ হতে হত - নারদ চরিত্রটি তার প্রমাণ। ঘটকরা তাদের ব্যবসায়িক বুদ্ধির চাতুর্যে নেশাখোর, দরিদ্র, বৃদ্ধ বরকে সুযোগ্য পাত্রে পরিণত করত। ফলে কুল অক্ষত রাখতে পিতা-মাতা গুণাগুণ নয়, কৌলিন্য বিচার করে কন্যাকে অযোগ্য পাত্রে সমর্পণ করত।


মাত্র আট বছর বয়সে গৌরীর বিবাহ হয় বৃদ্ধ ও অকর্মণ্য শিবের সঙ্গে। এতে সমাজের অনুশাসন রক্ষিত হলেও মাতৃহৃদয়ের শঙ্কা দূরীভূত হত না। আবার বহুবিবাহ প্রথার ফলে তৎকালীন সমাজের সতীন কোন্দলের চিত্রটি ফুটে উঠেছে। তার প্রমাণ নিম্নোক্ত পদটিতে পাওয়া যায়-


“একে সতীনের জ্বালা না সহে অবলা যাতনা প্রাণে কত সয়েছে
তাহে সুরধনী, স্বামী সোহাগিনী সদা শঙ্করের শিরে রয়েছে।”


বিবাহ অনুষ্ঠানে কন্যাপক্ষের তুলনায় বরপক্ষের মর্যাদা বেশি ছিল। কুলীন বরের মর্যাদা রক্ষার কথাও কয়েকটি পদে বলা হয়েছে-


“শিবকে পূজবে বিল্বদলে সচন্দন আর গঙ্গাজলে
ভুলবে ভোলার মন।”




তৎকালীন সমাজে নারীরা যে কত পুরুষ মুখাপেক্ষী হয়ে থাকত ও পরাধীন জীবনযাপন করত গৌরীকে দেখার জন্য মেনকার স্বামীর প্রতি উক্তিতে তা প্রকাশ পেয়েছে-


“কবে যাবে বল গিরিরাজ গৌরীরে আনিতে
ব্যাকুল হৈয়েছে প্রাণ উমারে দেখিতে হে।
……………………………………………………
কামিনী করিল বিধি তেঁই হে তোমারে সাধি
নারীর জনম কেবল যন্ত্রণা সহিতে।”


অবশেষে গিরিরাজ গৌরীকে আনতে গেলেন হরপুরে। পুরুষ হিসাবে স্বামী যত অপদার্থই হোক না কেন যেকোন কাজে স্ত্রীকে তার অনুমতি নিতে হয়। পার্বতী তাই অনুমতি প্রার্থনা করেছে-


“গঙ্গাধর হে শিবশঙ্কর কর অনুমতি হর
যাইতে জনক ভবনে।”


এটিকে স্বামীর অধিকারবোধের প্রতীকরূপেই দেখতে হবে।




এরপর কন্যা পিতৃগৃহে আগমন করত। তখন সেই আনন্দে মা-বাবার সঙ্গে পাড়া-প্রতিবেশীরাও যোগ দিত। সেকালের প্রতিবেশীদের মধ্যে এক নিবিড় আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। তাই উমাকে অপাত্রে দান করার জন্য তারা যেমন মেনকাকে ভর্ৎসনা করেছেন তেমনই উমার আগমনে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়েছে। উমাও প্রতিবেশীদের ঘরে সারাদিন ঘুরে বেড়াত-


“অনুরোধ উমা এড়াতে না পেরে
সারাদিন বেড়ায় প্রতি ঘরে ঘরে।”


তারপর বিজয়া, উমার বিদায়ের সময় মা মেনকা তাকে যেতে দিতে চান না। কিন্তু সে মনের কথা সরাসরি শিবকে বলতে পারছেন না। কারণ তৎকালীন সমাজে শাশুড়ি-জামাইয়ের মুখোমুখি কথোপকথন হত না। তাই শোকাকুলা মেনকা জামাইকে নিজে অনুরোধ না করে স্বামীকে বলে-




“শুন হে অচল রায়
বল গিয়ে জামাতায়
আমি পাঠাব না উমা
দিগম্বরে যেতে বল।”


কিন্তু শেষপর্যন্ত মেনকার সব আকুতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কারণ তৎকালীন স্বামী সমাজের প্রতিনিধি শিব তখন জননীর স্নেহাঞ্চল থেকে তার হৃদয়নিধিকে ছিনিয়ে নিতে এসেছে-



“বিছায়ে বাঘের ছাল দ্বারে বসে মহাকাল
বেড়োও গণেশ মাতা ডাকে বারে বার।”


  আগমনী বিজয়ার পদগুলি এভাবেই হয়ে উঠেছে লোকজীবনের ভাণ্ডার। এই গানগুলিতে বাংলার নানারূপ সমাজচিত্রের প্রতিলিপি পাওয়া যায়। কন্যার তত্ত্ব কিভাবে করতে হয়, জামাইয়ের সঙ্গে লোকাচারের নিয়মকানুন কিরূপ ছিল, তৎকালীন গোষ্ঠী জীবনের মধ্যে হার্দিক সম্পর্ক কিরূপ ছিল, সতীনের সংসার, কন্যার দুরবস্থার কথা ভেবে জননী মন কিভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠত-এমন বহু তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র সংবাদে শক্তিশালী শাক্ত পদাবলী




   শাক্ত পদাবলীর গানগুলি এই যুগের হতাশ বাঙ্গালীর প্রাণে দুঃখের মধ্যেও সান্ত্বনা দিয়েছিল, মৃত্যুর মধ্যে অমৃতের স্বাদ এনে দিয়েছিল। বৈষ্ণব পদাবলীর মত এখানে সূক্ষ্ম কলারূপ না থাকতে পারে কিন্তু আছে অতৃপ্ত জীবনের স্পর্শ। দেশকাল নির্বিশেষে নানা বিচিত্র বিধি-বিধানের যূপকাষ্ঠে বলিপ্রদত্ত অসংখ্য কন্যার আর্ত-দীন কন্ঠের সঙ্গে সমীকৃত হয়ে গেছে এই গান।


  অষ্টাদশ শতাব্দীর বিপদলগ্নে জনসাধারণ যে মাকে পূজা করেছিল তিনি ঐহিক উন্নতির অপরিহার্য শর্ত নিয়ে এসে দাঁড়াননি, ভক্তের বামহস্তে নিক্ষিপ্ত পূজা-পুষ্পের জন্যেও কাঙালপনা করেননি, তিনি নিজের সকরুণ জীবন মুকুরে তৎকালীন সমাজজীবনের বাস্তবচিত্র তুলে ধরেছেন মাত্র।





👉👉   শাক্ত পদাবলী ধারার অন্যতম উল্লেখযোগ্য কবি কমলাকান্ত সম্পর্কে এখানে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি এছাড়াও বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলি সম্পর্কেও আমরা পরপর আলোচনা করছি। প্রয়োজনে সেই সকল প্রশ্ন গুলি এখানে ক্লিক করে দেখে নিতে পারেন

Comments

Popular posts from this blog

MP 2020 History MCQ suggestions, part 6th,

সপ্ত প্রবাহের নীতি। মাধ্যমিক কমিশনের সপ্ত প্রবাহের নীতি।

Four pillars of Education - শিক্ষার চারটি স্তম্ভ | Delors Commission 1997