মায়ামৃদঙ্গ উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা বিচার করো | মায়ামৃদঙ্গ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

    লেখক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের অন্যতম সাহিত্য সৃষ্টি মায়া মৃদঙ্গ । উপন্যাসটি সমকালীন সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে এই উপন্যাসটি এক বিচিত্র জনজীবনের রূপ রীতির দলিল হিসেবে গৃহীত হয়েছে। আধুনিক বাস্তবতা গ্রাম কেন্দ্রিক জনজীবনের মানবিক বিকলন সম লিঙ্গের উন্মত্ত যৌনতার এক প্রেক্ষাপট এই উপন্যাসে সাহিত্যিক ভঙ্গিমায় তুলে ধরা হয়েছে। বিচিত্রমুখী এই উপন্যাসটির, মায়ামৃদঙ্গ উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা নিয়ে নিচে আলোচনা করা হলো।


মায়ামৃদঙ্গ উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা।


   সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘ মায়ামৃদঙ্গ ’ উপন্যাসের মূল বিষয় এবং সেই বিষয়ের সঙ্গে জড়িত শিল্পী কলাকুশলীর সঙ্গে ব্যক্তি সম্পর্কের পারিবারিক বৃত্ত এমন ভাবে গঠিত করা হয়েছে যে গড়পত্তা একটা ভাব নগর নির্মাণ করা গেছে। উপন্যাসের নামকরণের প্রসঙ্গে এধরনের একটা কাঠামোগত বিন্যাসের কথা তুলে ধরার অবকাশ নিয়ে হয়তো বিতর্ক থাকতে পারে। আসলে উপন্যাসের মূল বিষয়টা আবার একটা অন্তর্গত মিথ বা গুঢ় অর্থপূর্ণভাব ব্যক্ততার ওপর টিকে আছে। এই ভাব ব্যক্ততা হল ভাব তত্ত্ব সংক্ষেপে মায়াতত্ত্ব

        সাহিত্যে নামকরণের কতগুলি রীতি আছে  -

    ★চরিত্র ভিত্তিক নামকরণ।
    ★বিষয় বা ঘটনা ভিত্তিক নামকরণ।
    ★ভাব ব্যঞ্জনা মুলক নামকরণ।
    ★প্রতিধর্মী বা সাংকেতিক নামকরণ।
  
  এই চার রীতির নামকরণের কথা মায়ামৃদঙ্গ উপন্যাসের ভাবতত্ত্ব হল মায়াতত্ত্ব এই উপন্যাসটি কে ভাবব্যঞ্জনামূলক পর্যায়ে ফেলা যায়। তবে এই উপন্যাসটিকে ভাবতত্ত্বমূলক উপন্যাসও বলা যেতে পারে।
মায়ামৃদঙ্গ উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা


       মায়ামৃদঙ্গ উপন্যাসের বিষয় আলকাপ পৌরনাট্য এই দিকে লক্ষ্য রেখে উপন্যাসের নামকরণ আলকাপ হতেই পারত কিংবা আলকাপ ওস্তাদ নামকরণের বাধা ছিল না। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কিংবা নায়ক ওস্তাদ ঝাঁকসার নামানুযায়ী ‘ওস্তাদ ঝাঁকসা’ কিংবা ‘ ওস্তাদ ধনঞ্জয় ’ নামকরণ করা যেত। কিন্তু উপন্যাসিক বিষয় বা চরিত্র ভিত্তিক নামকরণের দিকে নজর ছিল না। কারণ আলকাপ লোকনাট্য দাঁড়িয়ে আছে মায়া নামের নারীর ছায়ায় গঠিত বিরল মায়ার কায়া নাচিয়ে ছোকরার ওপর,তার কণ্ঠের মায়া জড়ানো গানের ওপর। সেই মনকির ওস্তাদের গানের কলির মত —

                 “মন কি মিলেরে 
                    মনের মানুষ না হইলে,মনের                            কথা না কইলে।”
  
  হ্যাঁ,আলকাপ হলো মনের মানুষের কথা মনের মানুষের ভাবের কথা লোকসঙ্গতে কবি বলেন —  ‘যে জন প্রেমের ভাব জানে না তার সঙ্গে নাই        লেনা দেনা ’। আলকাপ হলো প্রেমের ভাব নগর। সে নগরে এক পড়শী বসত করে সে পড়শী মনের মানুষ,ভাবের মানুষ।

        আশ্চর্যের বিষয় পুরুষে পুরুষে বন্ধুত্ব হয়  (সমকামিতা নয়), পুরুষ পুরুষের জন্য যুবতী ঘরনির যৌন আবেদন অবজ্ঞা করে যে জন্যে সেটাই কিশোডর নাচিয়ে ছোকরার মায়াবী আবেদন। তার একটু ছোয়া পেতে কত জন ঘর ছেড়েছে,তাদের ঘরনীরা অভিসম্পাত করেছে। মায়াবী ছোকড়াকে ওস্তাদ ঝাঁকসা নাচিয়ে ছোকরার বিকল্পে তার মেয়েকে দলে নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বলেন —

            ‘ নারীতে সেই মায়া জমে না। ’

  আলকাপের পালা পরিবেশনা বহিরঙ্গের ব্যাপার এটা বাইরের মহল আলকাপের অন্দরমহল জটিল সেখানেই নাচিয়ে ছোকড়াকে নিয়ে সেই বিরল মায়া কিংবা অমত্য মায়ার খেলা চলে। তাকে ঘিরে চলে মায়া নামে নারীর মায়ার খেলা। সে খেলা আসর চমকায় তার মধ্যে থাকে পুরুষাত্তিগ নারীর বার্তা আবার নারীরাতিস নারীর বার্তা —

     “পুরুষ কখনও নারী হয় না,তার অর্থ হল         ‘নারীলোকে’এর যা সব সুন্দর সুন্দর জিনিস —      ভালোবাসা বলো,মায়ামমতা বলো,স্নেহ বলো কি দয়া ধর্মই বলো পুরুষ লোকের মধ্যে আশা করেছো তো মরেছো। কিন্তু আলকাপের শিল্পী যে তা মানে না। সে পুরুষের মধ্যে খুঁজে পেতে চাই কাম্য নারীকে। ঘরের নারী তার মন টানতে পারে না। তার মনের সবটুকু জুড়ে থাকে সেই ছোকরা......... সে এক অদ্ভুত মায়ার জগত।”

     আলকাপের অন্দরমহলে ওস্তাদ এবং মোহনীর ছোকরা মিলে এক অতল সংসার। এই সংসার ঘর গৃহস্থালির। সংসারের বাধনের চেয়ে গূঢ় গঙ্গামনির যৌবনাচ্ছ্বল রুপ,তাকে নিবিড় করে পাওয়ার কামনায় তত্ত্ব আলিঙ্গন ও চুম্বন ওস্তাদ ঝাঁকসাকে ধরে রাখতে পারেনি। ঝাঁকসা তাকে অভুক্ত রেখে শুয়ে থাকত শান্তির অমর্ত্য মায়ার বন্ধনে।

       ‘মায়ামৃদঙ্গ’ উপন্যাসে ওস্তাদ ঝাঁকসার সমান্তরালে রয়েছে সোনা ওস্তাদ ও সুবন রাঙ্গামাটির আসরে ওস্তাদ ঝাঁকসার সাথে এদের দেখা হয়। ঝাঁকসা মায়াতত্ত্ব তাদের নিজে বলেছে। কিভাবে মায়া জাগা গড়ে ওঠে —
      “চোদ্দটা উজ্জ্বল বাতির আলোয় হাজার হাজার বিমুগ্ধ মানুষের মাঝখানে সারাটি রাত ধরে মায়া আস্তে আস্তে,চুপি চুপি মনের গভীরে জাল বিস্তার করে অভ্যাসকে গড়ে তোলে সংস্কার তারপর একদিন চোখ দুটো বদলে যায়। আমি আছি ?কিন্তু কোথায় আছি?মায়ার মধ্যে আমার থাকা....... ”

  সোনা ওস্তাদ ও প্রেয়সী সুধাকে অবজ্ঞা করে আর সুবর্ণের মধ্যে খুঁজে পাই অমর্ত্য পুষ্পের ঘ্রান। সুবর্ণের শরীরে সে অনুভব করে সে এক অমল কাঠিন্য। সে পেল কাঠিন্যের স্বাদ। অন্যরকম তা নেশা ধরিয়ে দেয় দেহে। সুধার মধ্যে সেইগুলি মে নেই। আসরে উঠে সোনা ওস্তাদ ভাবে —
    “সুধা মরুক ! সুধা যা খুশি করুক সামনে হাজার বিমুগ্ধ মানুষের ভিড়ে ......... সুবর্ণকে জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া বলে মনে হয়েছে।”

    সোনা ওস্তাদ ও সুবর্ণ দল ছাড়া হয়ে যায়। দুজনে মগ্ন হয়। এবার তারা ওস্তাদ ঝাঁকসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এই যে তাদের নতুন পথের যাত্রা তা আদেও নতুন পথ নয়। এ খেলা চলছে নিরন্তর। সুধার মৃত্যু কিংবা গঙ্গামনির মৃত্যু এই দুই ক্ষেত্রেই দেখানো হয়েছে মায়া নামে নারীর অর্মত্য প্রেমের ছায়া — যার ছায়া পড়েছে এক কিশোর পুরুষের দেহে। যে ছায়া সারাবেলা নাচে। সেই ছায়াকে নিয়ে যত খেলা,পালাগান,কান্না,সুখ, ভালোবাসা ! তারা দুজনে একসাথে গেয়ে ওঠে ‘মায়ায় মায়ায় থাক না জন্ম যদি আরেক জন্মে সত্যি হয়’— গাইতে গাইতে তারা একে অপরের হাত ধরে একটা শরীর আর একটা শরীর ছোয়। কে যেন জাহার নামে হুঁশিয়ারি দেয় তবু সোনা ওস্তাদ হাত ছাড়ে না তিনি মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে যায় — ‘সে এক অমর্ত্য মায়া তাকে নিয়েই দেশে দেশে মৃদঙ্গ বাজে ’ অর্থাৎ নাগরা ঢোলের ধ্বনির মধ্যে আলকাপের কিশোর পুরুষ দেহ পরতের পর পরতে মায়া জড়ায় আর এক পুরুষ দেহ তাকে ছুঁয়ে যায়। এই আশ্চর্য মেলবন্ধনী মায়ামৃদঙ্গ ধ্বনীর পরিচয়। তাই এই উপন্যাসটির নামকরন ‘মায়ামৃদঙ্গ’ তত্ত্ব হিসাবে যেমন যথার্থ তেমনি ভাবব্যঞ্জনা মুলক হিসাবেও যথার্থ।


এছাড়া বাংলা সাহিত্যের অনন্য প্রশ্নগুলি 


👉👉  এখানে মায়া-মৃদঙ্গ উপন্যাসের নামকরণের রীতি বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিস্তারিত আকারে আলোচনা করা হলো আমরা বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়কে নোটস আকারে এখানে আলোচনা করে থাকি। প্রয়োজন অনুসারে আপনি এখান থেকে দেখে নিতে পারেন ।

TAG ::  মায়ামৃদঙ্গ উপন্যাস, মায়ামৃদঙ্গ, মায়ামৃদঙ্গ মুভি, মায়ামৃদঙ্গ অর্থ কি, মায়ামৃদঙ্গ সিনেমা, মায়ামৃদঙ্গ ফুল সিনেমা, মায়ামৃদঙ্গ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, মায়ামৃদঙ্গ, মায়ামৃদঙ্গ ওস্তাদ ঝাঁকসা, নামকরণ প্রসঙ্গ মায়ামৃদঙ্গ, মায়ামৃদঙ্গ উপন্যাসের ছোট প্রশ্ন, মায়ামৃদঙ্গ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ অধ্যায় 1, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের মায়ামৃদঙ্গ নামকরণ, মায়ামৃদঙ্গ উপন্যাসের প্রথম পর্ব ছোট প্রশ্ন, মায়ামৃদঙ্গ উপন্যাসের নামকরণ সম্পর্কে আলোচনা,মায়া মৃদঙ্গ

Comments

Popular posts from this blog

সপ্ত প্রবাহের নীতি। মাধ্যমিক কমিশনের সপ্ত প্রবাহের নীতি।

MP 2020 History MCQ suggestions, part 6th,

Four pillars of Education - শিক্ষার চারটি স্তম্ভ | Delors Commission 1997