মনসামঙ্গলের কবি নারায়ণ দেব - কাব্যপরিচয়, কবিকৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা - pdf
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ সবচেয়ে জনপ্রিয় তম পর্ব হলো মঙ্গলকাব্য আর এই মঙ্গলকাব্য ধারার অন্যতম বিষয় হলো মনসামঙ্গল। মনসামঙ্গলের জনপ্রিয় রচয়িতা দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এক কবি হলেন কবি নারায়ন দেব। মনসামঙ্গলের অন্যান্য কবিদের মতো তার কাব্য টি ও বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। আমরা এখানে কবি নারায়ন দেবের কাব্য পরিচয় ও কাব্য কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করলাম।
![]() |
Educostudy.in/নারায়ণ দেব |
মনসামঙ্গলের কবি নারায়ণ দেব
কাব্যপরিচয়ঃ
নারায়ণদেবের পদ্মপুরাণ বা মনসামঙ্গল তিনখণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ড আত্মপরিচয়, দেববর্ণনা ইত্যাদিতে পূর্ণ। দ্বিতীয় খণ্ডে রয়েছে পৌরাণিক ঘটনাবলী এবং তৃতীয় খণ্ডে চাঁদসদাগরের কাহিনী। দ্বিতীয় খণ্ডে পৌরাণিক আখ্যানগুলি প্রচুর পরিমাণে ও বিশদভাবে বর্ণিত।
সেজন্য দ্বিতীয়খণ্ডের পৌরাণিক আখ্যানগুলির সঙ্গে অনেকক্ষেত্রে তৃতীয় খণ্ডের কাহিনীগত সংযোগ নেই, তবুও সংস্কৃতে রচিত পুরাণগুলি এইভাবে কবির লেখনীর মাধ্যমে বাংলায় জনসাধারণের মত করে অনূদিত হয়েছে। সেদিক থেকে এর আলাদা গুরুত্বও রয়েছে। দেবখণ্ডের এই ঘটনাবগুলি তিনি সংগ্রহ করেছিলেন মহাভারতের আস্তিকপর্ব, বিভিন্ন শৈবপুরাণ এবং কালিদাসের কুমারসম্ভবম্ কাব্য থেকে
কবিকৃতিত্বঃ
নারায়ণ দেবের রচনায় একটি বড় দিক গভীর পাণ্ডিত্যের সঙ্গে স্বভাবসহজ কবিত্বের প্রকাশ। এরই কারণে তাঁর কাব্যে পাণ্ডিত্য অসহ্য বোঝা হয়ে ওঠেনি। স্বাভাবিকভাবে মনসামঙ্গলে করুণ রসের প্রাধান্য আর এই করুণ রসের সৃষ্টিতে নারায়ণদেব যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষত মনসামঙ্গল কাব্যের পরিসমাপ্তিতে তাঁর কাহিনী পরিকল্পনায় যে উচ্চস্তরের কবিত্ব শক্তির পরিচয় মেলে তা মনসামঙ্গলের অন্য কোন কবির সৃষ্টিতেই পাওয়া যাবে না। স্বামীর পুনর্জীবন নিয়ে ফিরে আসা বেহুলা মা সুমিত্রার সঙ্গে মুহূর্তের জন্য দেখা দিয়েছে, ধরা দেয়নি।
আত্মপরিচয় লিখে লিখে বেহুলা স্বামীর সঙ্গে স্বর্গ যাত্রা করল। দীর্ঘ বিচ্ছেদের অবসানে সন্তানকে ফিরে পেয়েও সুমিত্রার রুদ্ধস্নেহ বাহুবন্ধনে তাকে ধরে রাখতে পারল না। আসলে যেদিন বেহুলা প্রথম স্বেচ্ছায় গাঙুরের জলে কলার মান্দাসে মৃতের সহযাত্রিনী হয়েছে সেদিনই যে তার সহমরণ ঘটে গেছে। জীবিতের সমাজে এরপর তার ফিরে আসা যেন একটা রূপক। তাই ক্ষণমাত্র সমাজের আশঙ্কাসঙ্কুল উৎসুক চোখের সামনে দেখা দিয়ে বেহুলা অনন্তকালের জন্য হারিয়ে গেছে স্বর্গীয় রহস্যের অন্তরালে। মঙ্গলকাব্যের ইতিহাসকার আশুতোষ ভট্টাচার্য লিখেছেন –
“ইহা কি আদর্শবাদী সমাজে আদর্শ সতী চরিত্র কল্পনার ফল? বেহুলার প্রত্যাবর্তন পরিকল্পনা কি স্নেহময়ী সুমিত্রার সন্তানস্নেহাতুর জননী হৃদয়ে প্রতিফলিত অলীক সুখস্বপ্নের ছায়া? নারায়ণ দেব তাঁহার অশ্রুধারা ভারাক্রান্ত পাঠকের নিকট এই জিজ্ঞাসা রাখিয়া গিয়াছেন।”
কাহিনী পরিকল্পনায় আরেকটি ক্ষত্রেও নারায়ণ দেবের মুনশিয়ানা উল্লেখযোগ্য। চাঁদসদাগরের চরিত্রের সামঞ্জস্য রক্ষায় তিনি সফল। মুখ না ফিরিয়ে বাম হাতে চাঁদ একটা ফুল দিয়ে পূজা করেছে মনসাকে। অন্যান্য কবি এক্ষেত্রে চাঁদকে দিয়ে ঘটা করে মনসার পূজা করিয়েছেন যা চাঁদের পূর্বাপর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। কিন্তু এ ভুল নারায়ণ দেব করেননি।
প্রশ্নটির উত্তর পিডিএফ আকারে পেতে এখানে ক্লিক করুন
হাস্য ও করুণরস উভয় প্রকার সৃষ্টিতেই নারায়ণ দেব সমান দক্ষতা দেখাতে পেরেছেন। বিশেষত ব্যঙ্গ বিদ্রুপ সৃষ্টিতে কবির মুন্সিয়ানা নিশ্চয়ই স্মরণীয়। ডোমনী বেশিনী চণ্ডীর প্রতি মহাদেবের আসক্তি দেখে দেবী ব্যঙ্গ করেছেন –
বানরের মুখে যেন ঝুনা নারিকেল।
কাকের মুখেতে যেন দিব্য পাকা বেল।।
বৃদ্ধ হইলে পাইকের ভাব কী মাত্র সার।
তোমার মুখে বাহ আমাক বল করিবার।।
কিন্তু এই ব্যঙ্গ রসসৃষ্টিকে ছাপিয়ে নারায়ণদেবের কাব্যে করুণ রসই অসামান্য স্ফূর্তি লাভ করেছে। জীবনের চরম মুহূর্তে বেহুলা বা চাঁদ সদাগরের চরিত্র বর্ণনায় কবি তাদের মূল পরিচয়টি ভুলে যাননি। সে পরিচয় নির্বিকার এবং যথেষ্ঠ দৈব নিপীড়নের উপরে মনুষ্যত্বের প্রতিবাদ স্পৃহা, আবার তারই মধ্যে ভেসে উঠেছে অসহায় মানবের ক্ষীণ কণ্ঠের আর্তনাদ। বিবাহ রজনীতে সদ্যমৃত স্বামীর বিছানা পাশে বসে বেহুলার কান্না পরাজিত নারীর হৃদয়ে করুণ আর্তি –
লখাই কোলে লইয়া বেউলা কান্দে।
পাপকর্মের ভাগে তোরে খাইল কালনাগে
প্রাণ গেল সসুরের বিবাদে।
অথচ এখানেও বেহুলা হার মানেনি। চোখের জল বুকের প্রতিজ্ঞা হয়ে ঝলসে উঠেছে-
যদি বেউলা হন সতী সাহসে জিয়াব পতি
জেন জশ ঘোষয়ে সংসারে।
জাইব দেবের পুরি রঙ জাইব বিষহরি
আমি জাইব জিনিব মনসারে।।
আবার এই বেহুলাই কলার ভেলায় স্বামীর মৃতদেহ ভাসিয়ে করুণ স্বরে বিলাপ করেছে–
জাগ প্রভু কালিনী নিশাচরে
ঘুচাও কপট নিদ্রা ভাসি সাগরে
প্রভুরে তুমি আমি দুইজন
জানে তবে সর্বজন
তুমি তো আমার প্রভু আমি যে তোমার।
মরা প্রভু নহ রে তুমি গলার হার।
দেবতাদের উদ্দেশ্যে ব্যর্থ অভিশাপে অশ্রুসজল বেহুলা বলে ওঠে –
শাপ দিয়া বিধাতারে করোঁ ভস্ম রাশি
বিধাতাকে কি দিম দোষ মুঞী কর্মদোষে
উত্তর না দেহ প্রভু নাহি কর রাও
মুঞী অভাগিনীর দিকে চক্ষু মেলি চাও।।
কিন্তু নারায়ণ দেবের মুখ্য কৃতিত্ব চাঁদ সদাগরের অবিচল ব্যক্তিত্বের প্রকাশে। সব হারিয়ে গেছে তার, পুত্ররা মারা গেছে সত্যিই সে আজ পথের ভিখিরি, তবু হারার আগে হার না মানার দুরন্ত মানসিকতা তাকে অমর করে রাখে। শোকে আবেগঘন তীব্র মুহূত্তেও আত্মসম্মানদীপ্ত অনমনীয় পৌরুষ চাঁদ সদাগর তীব্র প্রতিহিংসায় বলে ওঠেন-
কোন দোস পাইয়া মোর কাটীল বাউগান
অকারণ বুড়াইল ডিঙ্গা চৈদ্দ খান
দালমূল গেল মুর মৈদ্ধ হৈল সার
অখনে কানির সনে চাপি কবোঁ বাদ
যদি কানির লাইস পাই একবার
কাটিয়া সুজিব আমি মরা পুত্রের ধার।
এ চরিত্রের এই হল বৈশিষ্ট্য। শোকে উন্মাদ, প্রতিহিংসায় অসুর শক্তি, স্বার্থে সংকীর্ণ, কিন্তু আদিম সরলতায় নিত্য প্রকাশ ভাস্বর। তার চরিত্রের এই বর্বরতা একালের কাছে অকাম্য। কিন্তু এরই মধ্যে লুকিয়ে আছে মহাকাব্যিক নায়কের সম্ভাবনা। তাই কেবল শোকের বিলাপ চিত্রণে নয়, শোকে দুঃখে আনন্দে বেদনায় ঔদার্যে স্বার্থপরতায় আদিম মনুষ্যত্বের ধীরদাত্ত স্বভাব বর্ণনায় নারায়ণদেব অপ্রতিম কবি।
প্রশ্নটির উত্তর পিডিএফ আকারে পেতে এখানে ক্লিক করুন
বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাসে তিনি আদিম বর্বর, মনুষ্যত্বের মহাকবি। তাঁর কাব্যের মহাকাব্য হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল, তবু যে তা হতে পারল না তার কারণ যুগস্বভাব। মঙ্গলকাব্যকে আসলে স্ক্যান্ডোনেভিয়া বা অ্যাংলো-স্যাক্সন যুগের লোক সাহিত্যের সঙ্গে সমান বলে মনে হয়। নারায়ণ দেবও সেই পর্যন্তই গেছেন, মহাকাব্যের স্রষ্টা হতে পারেননি।
👉👉 বাংলা সাহিত্যের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিয়ে আমরা এখানে আলোচনা করে থাকি আজ এখানে মনসামঙ্গলের জনপ্রিয় কবি নারায়ন দেব সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছি ও তার কাব্য পরিচয় সম্পর্কে বর্ণনা করেছি। এছাড়াও বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্ন গুলি আমাদের এখানে আলোচনা করা আছে আপনার প্রয়োজন হলে নিচের দেওয়া লিংক গুলিকে ফলো করতে পারেন।
Comments
Post a Comment