চন্ডীমঙ্গল কাব্যর কবি দ্বিজমাধব (Dwij Madhab) এর কাব্য পরিচয় ও কাব্য কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা - pdf
মঙ্গলকাব্যের চন্ডীমঙ্গল কাব্য শাখায় যে সকল কবি বর্গের নাম পাওয়া যায় তাদের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য কবি দ্বিজমাধব ( Dwij Madhab )। আমরা আগে বিভিন্ন মঙ্গল কবিদের কাব্য পরিচয় নিয়ে আলোচনা করেছি আর এখানে, আমরা কবি দ্বিজমাধব র কবি পরিচয় ও কাব্য কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করলাম -
চন্ডীমঙ্গল কাব্যর কবি দ্বিজমাধব
দ্বিজমাধব বাংলা মঙ্গলকাব্যের বৃহৎ প্রেক্ষাপটে একটি বিশিষ্ট নাম। মুকুন্দরামের ছত্রছায়ায় দ্বিজমাধবের কবিত্ব বাংলা সাহিত্যে আড়ালেই পড়ে রয়েছে। কিন্তু একথা যে কেউ মানবেন যে মুকুন্দরাম ভারতচন্দ্রের মত মুষ্টিমেয় উচ্চমানের কবিরা ছাড়া মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে দ্বিজমাধবই অগ্রগণ্য কবি। কবির প্রতিভা খুব বেশী ছিল না, কিন্তু বাস্তবপর্যবেক্ষণশক্তি যথেষ্টই ছিল। তার কাব্যখানি মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলের অসামান্য জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও বাংলায় প্রচারলাভ করেছিল। এটাও কম শ্লাঘার বিষয় নয়।
কবিপরিচয়
দ্বিজমাধবের কাল নিয়ে অনেক সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। অল্পশিক্ষিত পুথি নকলকারী ও গায়েনদের হাতে এ কাব্যের ভাষায় নানা পাঠান্তর ঘটে গেছে। তার উপর মাধব বা মাধবচার্য্য নামে একাধিক কবি শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল, গঙ্গামঙ্গল প্রভৃতি লিখে সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছেন। তএ দ্বিজমাধবের নামে পরিচিত সমস্ত পুথিতেই কাব্যরচনাকাল পাওয়া গিয়েছে –
ইন্দু বিন্দু বাণ ধাতা শক নিয়োজিত।
হদ্বিজমাধব গায় সারদাচরিত।
অর্থাৎ ১৫০১ শকাব্দে বা ১৫৭৯ খ্রীষ্টাব্দে এই গ্রন্থ রচিত হয়েছে। কবি আরেকস্থলে আকবরের নাম উল্লেখ করেছেন –
পঞ্চগৌরব নামে পৃথিবীর স্থান
একাব্বর নামে রাজা অর্জুন অবতার।
১৫৭৬ খ্রীষ্টাব্দ থেকেই বাংলার মুঘল অভিযান শুরু হয়। বাংলার প্রথম মুঘল সুবাদার জাহান খাঁ ১৫৭৫-৭৮ পর্যন্ত বাংলার অরাজকতা দূর করতে ব্যস্ত ছিলেন। সুতরাং কবি যখন চণ্ডীমঙ্গল রচনা করছেন তখন বাংলার আকবরের প্রচার হতে শুরু করেছে। কিন্তু দ্বিজমাধবের কাব্যের বহুল পরিচিতি ও প্রচার যেহেতু চট্টগ্রাম অঞ্চলেই ছিল সেই হেতু অনেকেই মনে করেন কবির জন্মস্থান চট্টগ্রাম। কিন্তু গ্রন্থারম্ভে আত্মকথা বর্ণনায় কবি লিখছেন –
সেইপঞ্চ গৌড় মধ্যে সপ্তদ্বীপ সার।
ত্রিবেণী যে গঙ্গা বহিছে ত্রিধারা।।
সপ্তদ্বীপ মধ্যে নদীয়ার যে মহাস্থান।
ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় শূদ্র অনেক প্রধান।।
পরাশর পুত্রজাত মাধব যে নাম।
কলিকালে হইত জগত অনুপান।।
কবি যদি ত্রিবেণীর কাছে সপ্তগ্রামেই জন্মগ্রহণ করেন তবে আকবরের উল্লেখ অস্বাভাবিক নয়। এছাড়াও কবি তার গ্রন্থে চট্টগ্রাম বা নদনদীর উল্লেখ করেননি। আসলে ষোড়শ শতাব্দীর নবদ্বীপবাসী শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল কাব্য রচয়িতা মাধবাচার্য্যের সঙ্গে দ্বিজমাধবকে গুলিয়ে ফেলা হয়, এমনকি আশুতোষ ভট্টাচার্যও তাই করেছেন। কিন্তু দ্বিজমাধবের আত্মকথাকে যদি প্রামাণিক ধরে নিতে হয় তাহলে মাধববংশতত্ত্ব কুলপঞ্জিকা দৃষ্ট ময়মনসিংহ জেলার মাধবাচার্য্যকে দ্বিজমাধব বলে মেনে নেওয়া যায় না। তবে এবিষয়ে আজও কোন শেষ সিদ্ধান্ত বলা যাবে না।
কাব্য ও কবি কৃতিত্ব
দ্বিজমাধব উচ্চতর কবিত্ব শক্তির হয়ত অধিকারী নন। আসলে মুকুন্দরামের আবির্ভাব না হওয়ায় তখনও বাংলা সাহিত্যে প্রতিভার কোন আদর্শ তৈরি হয়নি। পূর্বাপর সামঞ্জস্য রেখে কাহিনী গ্রন্থনা অথবা চরিত্র নির্মাণ কোন ক্ষেত্রেই তাই দ্বিজমাধব সীমা অতিক্রম করতে পারেননি। কাহিনীটিকে পাঁচালি ও ব্রতকথার ঢঙেই তিনি বিবৃত করেছেন। নাটকীয়তা বা সাহিত্যের রস তেমন কিছু সৃষ্টি হয়নি।
এই প্রশ্নের উত্তর pdf আকারে ডাউনলোড করুন বিনামূল্যে
কবির বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে অনাড়ম্বর ভাববর্ণনার গুণে নিরলংকার ভাষায়। বররণার এই সহজ চরিত্রই দ্বিজমাধবের কাহিনীর একমাত্র আকর্ষণ। লহনা খুল্লনার বিবাদ বহুবিবাহ পীড়িত বাঙালীর গার্হস্থ্য জীবনের কলঙ্করূপে অম্লান –
খুল্লনা বসিলা ছেলী খুইয়া অজাসালে
মানের পাতে লহনার খুদের অন্ন রাঁধে
লহনার বাক্যে রামা সহিতে না পারে
ছাগল লইয়া চল কানন ভিতরে।
স্বাভাবিকভাবেই কল্পনার কোনো অবকাশ এখান নেই, যা আছে তা বাস্তববতার প্রত্যক্ষ বর্ণনা। প্রত্যক্ষদৃষ্ট বাঙালী জীবনকে বর্ণনার মধ্যেই কবি থেমে রয়েছেন। মুকুন্দরামের মত সেখানে মানবচরিত্র সৃষ্টির কৌশল যুক্ত হয়নি। শুধু এর মধ্যে ব্যতিক্রম ভাঁড়ুদত্তের চরিত্রটি। ভাঁড়ুর স্বার্থপরতা কবি বেশ রসিয়ে বর্ণনা করছেন। অবশ্য তার অপরাধের মত শাস্তিও বেশ যথেষ্টই। শঠতায় তার সংসার চলে –
ভাঙা করি ছয় বুড়ি গামছা বান্ধিয়া
ছাওয়ালের মাথায় বোঝা দিলেক তুলিয়া
কড়ি বুড়ি নাই ভাঁড়ুর বাক্যমাত্র সার
ত্বরায় পাইল গিয়া নগর রাজার।
ভাঁড়ু শুরু প্রতারক নয়, নির্লজ্জও বটে। তাই কাতকেতুর আদেশে তার মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে যখন গঙ্গা পারে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হল তখন সেখানেও গিয়ে সে বলেছে –
"গঙ্গা পারে গিয়া মুড়াইয়াছি মাথা।"
আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন যথার্থই বলছেন ‘মাধুর ভাঁড়ুদত্ত কবিকঙ্কনের ভাঁড়ু হইতে শঠতায় প্রধান।’ কবির পাণ্ডিত্য যথেষ্ট যে ছিল তার প্রমাণ কাব্যের পৌরাণিক ঘটনা তন্ত্র-যোগসাধন-ধর্মবন্দনা-বৈষ্ণবীয় ভাবাদর্শ প্রভৃতি বিচিত্র বিষয়ের সমাহার।
![]() |
Educostudy.In/Dwij-Madhab |
যদিও তাঁর কাব্যের প্রচার চট্টগ্রামেই বেশি তবু পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপটেই তাঁর কাহিনী বর্ণিত। তবু দৃষ্টিকে সৃষ্টিকার্যে নিয়োগ করেননি বলেই মনের সংযোগ তাতে ঘটাননি বলেই দ্বিজমাধবের চণ্ডীমঙ্গল পাঁচালী ব্রতকথার ক্ষুদ্রসীমা ছারিয়ে মহৎ কাব্যের উচ্চলোকে উত্তীর্ণ হতে পারেনি।
- বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলি CLICK HERE
👉👉 এখানে আমরা চন্ডীমঙ্গল কাব্যের উল্লেখযোগ্য কবি দ্বিজমাধব কবি পরিচয় কাব্য কাল কাব্য বৈশিষ্ট্য ও কাব্য পরিচয় নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করলাম। এছাড়াও বাংলা সাহিত্যের অন্য সকল প্রশ্ন গুলির জন্য উপরে দেওয লিঙ্ক টিকে ফলো করতে পারেন।
Comments
Post a Comment