ধর্ম মঙ্গলের কবি ঘনরাম চক্রবর্তীর (Ghanaram-Chakrabarty) কবি পরিচয় ও কাব্য কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা - pdf
মঙ্গলকাব্যের ধর্মমঙ্গল কাব্য শাখায় যে সকল কবি বর্গের নাম পাওয়া যায় তাদের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘনরাম চক্রবর্তী ( Ghanaram-Chakrabarty )। আমরা আগে রূপরাম চক্রবর্তীর কাব্য পরিচয় নিয়ে আলোচনা করেছি আর এখানে, আমরা কবি ঘনরাম চক্রবর্তীর কবি পরিচয় ও কাব্য কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করলাম -
ঘনরাম চক্রবর্তী
ধর্মমঙ্গলের কবিদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত কবি ঘনরাম চক্রবর্তী। মনে হয় মঙ্গলকাব্যধারার তিনিই প্রথম কবি যার কাব্য মুদ্রণ সৌভাগ্য লাভ করেছিল। রূপরামের চেয়ে প্রচারিত হবার সুযোগ ঘনরাম সেই কারণেই বেশি পেয়েছেন।
কবির কাল ও পরিচয়
আয়তনে মহাকাব্যতুল্য গ্রন্থের সমাপ্তিতে কবি তার কাব্যের রচনাকাল নির্দেশ জ্ঞাপক কয়েকটি ছত্র লিখে গেছেন –
সঙ্গেত আরম্ভকাল নাহিক স্মরণ।
শুন সবে যে কালে হইল সমাপন।।
শক লিখে রাম গুণ রস সুধাকর।
মার্গকাদ্য অংশে হংস ভার্গব বাসর।।
সুলক্ষ্য বলক্ষ পক্ষ তৃতীয়াক্ষ তিথি।
যামসংখ্য দিনে সাঙ্গ সংগীতের পুথি।।
পণ্ডিতগণ এই রচনাকাল জ্ঞাপক পয়ার পরীক্ষা করে বলেছেন যে ১৬৩৩ শকাব্দ বা ১৭১১ খ্রীষ্টাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে শুক্রবার শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে তাঁর গ্রন্থ রচনা শেষ হয়। বর্ধমান জেলার দামোদর নদের তীরে কৃষ্ণপুর গ্রামে ঘনরামের জন্ম। বাবা গৌরীকান্ত, মা সীতা দেবী।
![]() |
Educostudy.In/Ghanaram-Chakrabarty |
ছোটবেলা থেকেই কবি প্রতিভার অধিকারী ঘনরাম তার আচার্য্যের কাছে ‘কবিরত্ন’ উপাধি লাভ করেন। তাঁর কাব্যে বর্ধমানের রাজা কীর্তিচন্দ্রের উল্লেখ আছে বলে কেউ কেউ মনে করেন যে তিনি তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। কবির চারপুত্র এবং প্রত্যেকেরই নামের সঙ্গে রাম শব্দটি যুক্ত আছে। এর থেকে অনুমান করা হয় যে কবি হয়ত রামভক্ত ছিলেন।
কাব্য ও কবিকৃতিত্ব
ঘনরামের কাব্যের দেবতার স্বপ্নাদেশের কোন উল্লেখ নেই উপরন্তু গুরুর আদেশেই কবি কাব্যরচনা করছেন বলে উল্লেখ করেছেন। সংস্কৃতে পণ্ডিত কবি আর সেই পাণ্ডিত্যের ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত রয়েছে তাঁর কাব্যে। অসংখ্য পৌরাণিক কাহিনীতে তাঁর কাব্য পূর্ণ।
মঙ্গলকাব্যের নিজস্ব নিয়মকানুনের সঙ্গে এই পৌরাণিক কাহিনীর প্রাচুর্য ঘনরামের কাব্যের বিপুলায়তনের জন্য দায়ী। তাঁর ভাষা মার্জিত বোঝাই যায় বাংলা সাহিত্যের একটি বিদায়ী যুগের কবি। তিনি সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার করেছেন যেমন তেমন দেশী শব্দও ব্যবহার করেছেন প্রচুর –
কুলা ডালা বুনিতে বাঁশের বান্ধে বেতি।
ধুচুনি চুপড়ি ঝুড়ি পেরা ছাতাছাতি।।
পতিবেত বোঝা বান্দি হাঁকাইল বরা।
কুক্কুট পায়রা হাঁসে সাজিল বাজরা।।
ছন্দের দ্রুততা ঘনরামের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। লাচারী ছন্দের দীর্ঘ বিলাপোক্তি তার কাব্যে নেই। তার জায়গায় ভারতচন্দ্রের আগমনের ইঙ্গিত রয়েছে ছন্দের গতিময়তায় এবং উপযুক্ত শব্দ প্রয়োগে। তার দৃষ্টান্ত রয়েছে যুদ্ধের বর্ণনায় –
টন্টান ঠন্ঠান ঢাল চলে ঢন্ঢন্
ঝন্ঝান্ ঘন রণনাদ।
দেখিতে বিপরীত চৌদিকে চমকিত
মানুদা ভাবে পরমাদ।।
ছন্দের মত অনুপ্রাস অলংকার প্রয়োগেও কবি যথেষ্ঠ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন –
গদগদ গরুড় গোবিন্দ গুন গায়।
গুড়ি গুড়ি গরুড় গমনে গুড়ি যায়।।
এছাড়া ব্যজস্তুতি অলংকারও কবি প্রয়োগ করতে পেরেছেন। এছাড়া কিছু উদ্ভট শ্লোকের সুন্দর ও সহজ বাংলা অনুবাদ ঘনরামের কৃতিত্ব –
কুপুত্র হইলে কুলে কুলাঙ্গার কহে।
কুবৃক্ষ কোটরে অগ্নি উঠে বনদলে।।
তাঁর রচিত বহুপদ আহ বাংলার প্রবচন সাহিত্যে প্রবেশ করে গেছে। তাঁর সৃষ্ট হাস্যরসে ভাঁড়ামি নেই তা উচ্চাঙ্গের রুচির পরিচায়ক এবং সাবলীল।
এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যগুলি বাদে ঘনরামের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব চরিত্র সৃষ্টিতে। লাউসেন ধর্মের প্রভাবপুষ্ট হয়েও মানবিক গুণে উজ্জ্বল। পিতার প্রতি ভক্তিমান, নির্ভীক এক অসামান্য বীর সে। তার তপস্যায় সূর্য পশ্চিমে উঠেছে। সে এই কাব্যের বিজয়ে নায়ক।
খলচরিত্র হিসাবে মহাম্মদ চরিত্রটিও অনবদ্য। তার মতামত না নিয়ে কর্নসেন রঞ্জাবতীর বিবাহ তাকে যে অপমান করেছে তার প্রতিশোধে মহামদ হয়ে উঠেছে নির্দয়। অপ্রধান চরিত্র হিসাবে কালুডোম, লখাই স্নেহশীলতা-সাহস কর্তব্য পরায়নতায় জীবন্ত। বাস্তবতার মহিমাদীপ্ত।
ঘনরামের কাব্যে করুণরসের অভাবই বোধ হয় বীররসের অর্গল উন্মোচন করে দিয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আহত লাউসেনের পত্নী কলিঙ্গা প্রাসাদদ্বারে ফিরে প্রাণত্যাগ করল। যোদ্ধৃবেশিনী কলিঙ্গার শবদেহ বঙ্গে ধারণ করে স্বপত্নীর শোকে কানাড়া কেঁদে আকুল। তবু সে কান্না মুহূর্তের জন্যে। দুর্মুখা দাসী এসে তাকে প্রবোধ দিল –
কেঁদো না সুন্দরী শুন উঠ বুক বেঁধে।
মরিলে কে কোথাকারে প্রাণ পেল কেঁদে।।
শোকের সময় নয় শত্রু আসে পুরে।
সংহার সংগ্রামে সাজি শোক ত্যজ দূরে।।
যে যুদ্ধে মা ছেলেকে হারালো, ভাইকে হারালো ভাই তাতেই আত্মবিসর্জনে আত্মবিলাপ ভুলতে চায় জননী। নিহত ভাইয়ের ঘোড়া নিয়ে প্রতিশোধ রণক্ষেত্রে প্রবেশ করে ভাই। সেখানে চোখের জল ফেলার অবকাশ কোথায়? তবু এরা হৃদয়হীন নয়। মায়ের মুখ থেকে ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে মায়ের আদেশেই যুদ্ধসজ্জা করছে শুকা। তবু কাঁদছে আর বলছে –
প্রশ্নটির উত্তর পিডিএফ আকারে পেতে এখানে ক্লিক করুন
প্রতিভা ছিল তার, আর ছিল যুগের দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশের ক্ষমতা। তাইত তার জনপ্রিয়তা। সময়টা আঠারো শতক। জনজীবনে অরাজকরতার অন্ধকার ঘনায়মান। দূর দিল্লীর তখত-ই-তাউস নিয়ে জঘন্য ভাতৃদ্বয়ের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। রাজনৈতিক উত্থান পতনের সঙ্কুলাবর্তে রচিত এই কাব্যে বীরত্বের আদর্শই তাই স্বাভাবিক, কাতর বিলাপ নেহাতই কৃত্রিম। ঘনরাম সেই অকৃত্রিম বীরত্বের কবি।
👉👉 বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন কবি কাব্যচর্চা ইত্যাদি আলোচনার মতো এখানে আজ আমরা ধর্মমঙ্গলের অন্যতম কবি ঘনরাম চক্রবর্তী তার কবি পরিচয় কাব্য পরিচয় ও কাব্য কৃতিত্ব নিয়ে আলোচনা করেছি। এছাড়াও বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন প্রশ্ন উত্তর গুলি পাওয়ার জন্য উপরে দেওয়া লিংকটি তে ক্লিক করতে পারেন।
Comments
Post a Comment