শাক্তপদাবলির কবি রামপ্রসাদ সেনের ( Ramprosad-Sen ) কবি কৃতিত্ব আলোচনা করো।

  বাংলা সাহিত্যের উল্লখযোগ্য অধ্যায় শাক্ত পদাবলী, এই ধারার অন্যতম কবি রামপ্রসাদ সেন  ( Ramprosad-Sen )। শাক্তপদাবলির বিভিন্ন পর্যায় গুলিতে কবি বিশেষ ভাবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন। আমরা এখানে শাক্ত কবি রামপ্রসাদ সেন  ( Ramprosad-Sen ) এর কবি প্রতিভা নিয়ে আলোচনা করলাম - 




রামপ্রসাদের কবিকৃতিত্ব

শাক্ত পদাবলী অষ্টাদশ শতাব্দীর ধর্ম ও মাতৃরসে জারিত এক উল্লেখযোগ্য কাব্যধারা। কোনও কাব্য সৃষ্টি স্বয়ম্ভু সাধনার ফল নয়। উৎপত্তিস্থল একটা থাকেই। সেই উৎসস্থল কবিদের প্রেরণারস্থল হয়, কবিকে প্রভাবিত করে। বৈষ্ণব পদাবলীই শাক্ত পদাবলীর উৎসকে নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত করেছেন। আবার কোন সৃষ্টি দেশ, কাল, সমাজব্যবস্থার ঊর্ধ্বে নয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে একদিকে বর্গীর হাঙ্গামা, শাসকদের অত্যাচারে বাঙালীর ধর্ম, প্রাণ সব কিছুতেই একটা নিরাপত্তার অভাব দেখা যায়।

শাক্তপদাবলির কবি রামপ্রসাদ সেনের Ramprosad-Sen কবি কৃতিত্ব
Educostudy.In/Ramprosad-Sen


  এরকমই এক জরাতুর কালে সাধক কবি রামপ্রসাদ এসেছিলেন তাঁর সাধনার অনুভূতিলব্ধ সুর ও ধ্বনি নিয়ে। তাঁর বাণীতে ক্লান্ত, অবসন্ন বাঙালী-জীবন মায়ের রক্তচরণ কমলে বিপদ মুক্তির শরণাগতি খুঁজেছে। সন্তানের আতুর ব্যাকুলতা মায়ের প্রতি দুহাত বাড়ানো স্নেহ প্রার্থনা রামপ্রসাদের ভবঘুরে জীবনের মহত্তর সাফল্য।




 শ্রমে ও সেবায়, বৈরাগ্যে ও ব্যর্থতায়, প্রার্থনায় ও বার্ধক্যে, স্নেহবুভুক্ষার কম্পিত মুহূর্তে কিংবা ভক্তির আকণ্ঠ ক্রন্দনে নৈসর্গিক আবেগের বাণীরূপ রামপ্রসাদের পদাবলী। তাই বাঙালীর অতি কাছের মাটির গন্ধমাখা জীবন প্রসাদী সুরের মধ্য দিয়ে আজকের আধুনিক সংস্কৃতির যুগেও অতি সহজে প্রবেশ করে আমাদের বাতায়ন পাশ দিয়ে।


অষ্টাদশ শতাব্দীতে শক্তিমানের হঠকারী শাসনে, অদৃষ্ট রাজার নামে রাজপুরুষের ঘৃণ্য অত্যাচারের ফলে নাগরিকতায় অনপুযুক্ত গ্রাম্য মানুষগুলি বাধ্য হয়ে নগরের দিকে চালিত হল। নিষ্ঠুর দুর্ভাগ্য যদি পুরুষানুক্রমে কৃষিজীবী জমি থেকে উৎক্ষিপ্ত করে প্রবাসে মুহুরিগিরির বৈষয়িক জটিলতায় নিয়োজিত করে, সেই বিষয়ান্তরিত জীবনের ব্যর্থতা তার স্বভাব-সংগত চিত্রকল্পেই আত্মপ্রকাশ করে। রামপ্রসাদের পদে হয়ত তাই ঘটেছে।




“মনরে কৃষিকাজ জানো না
এমন মানব-জমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা।”


অকর্ষিত মানবজীবনকে আধ্যাত্মিকতারূপ কৃষিকর্মের দ্বারা শস্যসম্ভব করার পিছনে কৃষিকর্মের ব্যর্থতা জনিত আক্ষেপটি একান্তই জীবিকা বঞ্চনার নিষ্ফলতা থেকে প্রক্ষিত হয়েছে।


আগমনী বিজয়ার গানে রামপ্রসাদের প্রতিভা অল্প প্রকাশিত। কিন্তু এই পদগুলিতে যে বাৎসল্যরসের প্রকাশ ঘটেছে তা চমৎকার। মেনকা কন্যাকে কাছে না পাওয়ার দুঃখে সিদ্ধান্ত করেছে-




“এবার আমার উমা এলে আর উমা পাঠাব না
বলে বলবে লোকে মন্দ কারো কথা শুনব না।”


দীর্ঘ অদর্শন পর মাতা-কন্যার মিলন মুহুর্তটি বর্ণনায় রামপ্রসাদ অসাধারণ কবিত্বশক্তির পরিচয় দিয়েছেন-


“উমা কোলে বসাইয়া চারুমুখ নিরখিয়া
চুম্বে অরুণ অধর।”


কিন্তু বিজয়ার দিনে উমাকে মহাকালের হাতে তুলে দিতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত মায়ের অবুঝ মন বলে ওঠে-




“তনয়া পরের ধন না বুঝিয়া বুঝে মন
হায় হায়, একি বিড়ম্বনা বিধাতার।”


জীবন যে এত সহজ অনাড়ম্বর অথচ মর্মস্পর্শী ভাষায়, ছন্দে, সুরে প্রকাশিত হতে পারে প্রসাদী গানের অবির্ভাব না হলে বাংলা সাহিত্য তা জানতেই পারত না।


তবুও সাধক কবি রামপ্রসাদ শ্রেষ্ঠ তাঁর সাধনাশ্রয়ী পদগুলোর জন্য। রামপ্রসাদ তন্ত্রসাধক। সাধারণ তন্ত্র সাধনায় সুকোমল হৃদয়বৃত্তি নেই; আছে কঠোর তপস্বা, তীব্র কৃচ্ছ্রতা। রামপ্রসাদ এই সকল তান্ত্রিক আচরাদির মধ্যেও, যে মা ব্রহ্মাণ্ডের পালয়িত্রী, এই সমগ্র বিশ্ব যাঁর চরণোৎক্ষিপ্ত ধূলিকণার ভগ্নাংশ, সেই অনির্বচনীয় শক্তিকে সন্তানের অসীম করুণায় আপনার ভগ্ন গৃহভিত্তির সংলগ্ন বেড়া বাঁধার কাজে নিয়োগ করেছেন, পরমাত্মরূপিণী আদিভূতা সনাতনীকে পারিবারিক পরিমণ্ডলের মধ্যে সংস্থাপিত করেছেন।




 এগুলি কবির মৌলিকতার স্বাক্ষরবাহী। রামপ্রসাদ জগজ্জননীর চরণে কেবল সাধনার জবাপুষ্প অর্পণ করেননি, বেদনার রসে বাৎসল্যের তর্পণ করেছেন। মায়ের প্রতি রামপ্রসাদের অভিযোগ তাই বাহ্যিক। তার অন্তর্নিহিত মাতৃনির্ভরতাই সবচেয়ে বড় কথা। জীবনে দুঃখের অভিজ্ঞতা লাভ করে তাই তিনি বলেছেন-


“মা নিম খাওয়ালে চিনি বলে কথায় করে ছলো
ওমা মিঠার লোভে তিতমুখে সারাদিনটা গেল।”




কলুর তৈলনিষ্কাষণ যন্ত্রের চারপাশে অন্ধ বলদের রাত্রিদিন চক্রাবর্তনের উপমায় এই প্রাণধারণের গ্লানি রামপ্রসাদের পদে সাধারণভাবে প্রকাশিত হয়েছে-


“ভবের গাছে বেঁধে দিয়ে মা, পাক দিতেছ অবিরত
তুমি কি দোষে করিলে আমায়, ছ’টা কলুর অনুগত।”


তবুও মাতৃচরণের প্রতি তাঁর পূর্ণ আস্থা আছে। অন্ধবৎ জীবনযাপনের যান্ত্রিক তাড়নায় তাই তাঁর একটিমাত্র সাধ-


“একবার খুলে দে মা চোখের ঠুলি
দেখি শ্রীপদ মনের মতো।”




সংসার জ্বালায় অশ্রুপাত শেষ করে, তারা নামের পুলকে গলদশ্রু হয়ে তাই কবি এবার বলেছেন-


“রামপ্রসাদ বলে, ভবের খেলায়, যা হবার তাই হলো
এখন সন্ধ্যাবেলায়, কোলের ছেলে, ঘরে নিয়ে চলো।”


বৈষ্ণবীয় গানে প্রেমভক্তির যে ধারা, বাৎসল্য রসের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে উগ্র তপস্বা আর মন্ত্রতন্ত্রের আয়োজন থেকে মানুষের মনকে মুক্তি দিয়ে জীবনের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। রামপ্রসাদের মৃত্তিকাগন্ধী এই গানগুলিতে সেই একই ধারার অনুরণন।




রামপ্রসাদের কবিভাষা সাদামাটা কথায় তাঁর পদে অভিব্যক্তি লাভ করেছে। আদ্যাশক্তি শ্যামার সঙ্গে তাঁর মা-ছেলের সম্পর্ক। রামপ্রসাদের রচিত পদগুলি, অষ্টাদশ শতাব্দীর হতাশার জড়িমায় আচ্ছন্ন মানুষের বড় সান্ত্বনার স্থল, বাস্তব দুঃখের একমাত্র প্রতিষেধক। রামপ্রসাদের ক্রন্দনের তীব্রতায় অসহায়তার উৎকণ্ঠ বিলাপ, কেবল নিশ্চিন্ত উদাসীন মাতাকে বিচলিত করে তাঁর অবশ্যপ্রদায়ী কৃপালাভের জন্য।


 শ্যামার সন্তান রামপ্রসাদ আধ্যাত্ম সাধনার বাস্তবতা ও কাব্যরসের ত্রিবেণী রচনা করে ভক্তিরসাশ্রিত গীতিসাহিত্যকে সার্থকতার পথে উত্তীর্ণ করে দিয়েছেন। অথচ তাঁর কাব্যের ছন্দ মধ্যযুগের বিলম্বিত তানপ্রধান ছেড়ে বাংলা ভাষার নিজস্ব স্বরবৃত্তে প্রকাশিত। রামপ্রসাদ অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে অনাগতকালের সমুদ্র-কল্লোল শুনতে পেয়েছেন।




 তাই তিনি দেবতা ও মানুষের সঙ্গে ব্যক্তিতান্ত্রিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। “মা আমায় ঘুরাবি কত”-বাংলা গীতিকবিতার এখানে প্রথম অস্ফুট ঊষারাগ। এই প্রথম কবিকণ্ঠ এক সম্প্রদায় নিরপেক্ষ নিঃসঙ্গ ব্যক্তিত্বকে দেবতার সামনে নিয়ে এলেন। যেখানে লোকায়ত মানবতাবাদ অন্তরের স্বতঃস্ফূর্ত গোত্রহীন ভক্তির নতুন সুর, নতুন কবিভাষার জন্ম দিচ্ছে। তাই প্রসাদী সঙ্গীতে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের অঙ্কুরোদ্গম


 অবশেষে বলা যায় বিষয়বিকার ও গার্হ্যস্থ বেদনার মধ্যে নিমজ্জিত থেকেও সূর্যমুখীর মত হৃদয়ের অতন্দ্র সাধনাকে যে ঊর্ধ্বচারী করে রাখা যায়, জীবনের সকল লাঞ্ছনা-বেদনার মধ্যেও মাতৃচরণের প্রতি প্রাণের সকল চাঞ্চল্যকে স্তবীকৃত করা যায়, গৃহী সংসারী আসক্ত মানুষের প্রতি এই শিক্ষাই রামপ্রসাদের কবিরূপে জনপ্রিয়তার মূলে।




👉👉   মধ্য যুগের একটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্য রেখা হলো শাক্তপদাবলি। এই ধারার বিশেষ কবি সাহিত্যিক রামপ্রসাদ সেন এর সম্পর্কে এখানে বিশেষ আলোচনার চেষ্টা করেছি। যদি আপনাদের এই লেখা গুলি ভালোলাগে তবে কমেন্ট করে জানাবেন। 

এছাড়া বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলি পেতে হলে নিচে দেওয়া লিংক টি তে ক্লিক করুন,  Click Here 

Comments

  1. অসংখ্য ধন্যবাদ

    ReplyDelete
  2. নামহীনJuly 25, 2023 at 7:26 PM

    একটু সহজ সরল ভাষা দিয়ে লেখার চেষ্টা করুন তাতে শিক্ষার্থীদের বুঝতে সুবিধা হবে

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

MP 2020 History MCQ suggestions, part 6th,

সপ্ত প্রবাহের নীতি। মাধ্যমিক কমিশনের সপ্ত প্রবাহের নীতি।

Four pillars of Education - শিক্ষার চারটি স্তম্ভ | Delors Commission 1997