শাক্ত ও বৈষ্ণব পদাবলীর বাৎসল্যরসের তুলনা মূলক আলোচনা

   বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দুটি প্রধান ধারা শাক্ত পদাবলী ও বৈষ্ণব পদাবলীশাক্তপদাবলী বৈষ্ণব পদাবলী বাংলা সাহিত্যে ভক্ত ও ভগবানের মিলন সংগীত রূপে বাংলা সাহিত্যের স্থান দখল করেছে। এখানে আমরা এই দুটি ভিন্ন ধারার বিষয়ের মধ্যে তুলনা মূলক আলোচনা করবো।




শাক্ত ও বৈষ্ণব পদাবলীর বাৎসল্যরসের তুলনা

সহস্র কবিকন্ঠের উন্মত্ত ভাববিলাসে, বিশ্বভৌম প্রেমের প্রবল আত্মপ্রচারে, চৈতন্য জীবনের জ্যোতিষ্মান চরিত্রগুণে ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীর বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্য সমৃদ্ধির শিখর স্পর্শ করেছিল। কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীর উপান্তে এসে বৈষ্ণব সাধনার জ্যোতির্ময় শশাঙ্কে নানাকারণে কলঙ্করেখা দেখা দিল।

শাক্ত ও বৈষ্ণব পদাবলীর বাৎসল্যরসের তুলনা মূলক আলোচনা
Educostudy.In/shakta-baishnab-podaboli


 বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের এই অস্তমিতকালে শাক্ত পদাবলীর আবির্ভাব। এই সময় শাক্ত কবিরা ঈশ্বর ও ভক্তের সঙ্গে, দেবতা ও মানুষের সঙ্গে মানবিক বৃত্তিযোগের সম্পর্কে একটি নতুন ভক্তিরসের প্রবর্তন করলেন। বিশ্ববিধানের লীলারঙ্গময়ী অট্টহাসিনী জননী সন্তানের বিব্রত বাৎসল্য ও বিষণ্ণ স্নেহের কায়াব্যূহে ধরা দিলেন।




বৈষ্ণব কবিরা নিত্য বৈকুণ্ঠের চিরন্তন চারণ, রাধাকৃষ্ণের নিত্য লীলার ধ্যান-দর্শক। এখানে মাতা-পুত্রের বাৎসল্যরসের ইতিবৃত্ত বড়ই সংক্ষিপ্ত। কিন্তু শাক্ত কবিরা একদিকে যেমন অষ্টাদশ শতাব্দীতে দুঃখের তিমিররাত্রির সিংহসদনে বসে ব্যক্তিগত ত্রাণকর্মীর বোধন মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন, অন্যদিকে তেমনই মাতা ও সন্তানের স্নেহ-বুভুক্ষু আবেগঘন সম্পর্ককে স্থাপন করেছেন নিজেদের সাধন আঙিনায়।


 শাক্তপদ স্নেহরসাশ্রিত, এর বিষয়বস্তু বাৎসল্য। উমা-মেনকা-গিরিরাজ এই দেবচরিত্রের মানবায়নের দ্বারা বাঙালী গার্হ্যস্থ জীবনের মাতা-কন্যার অমৃতমধুর সম্পর্ক ফুটে উঠেছে। অনেকে এই বাৎসল্যরসকে বলেছেন-“মধুররস ছাড়া আর কি হতে পারে।” কিন্তু বৈষ্ণব পদে ব্যবহৃত মধুররসের সঙ্গে এর পার্থক্য আছে।




বৈষ্ণব মতে রস পাঁচটি- শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর। তাই বৈষ্ণবের কাছে কৃষ্ণ-ঈশ্বর, প্রভু, সখা, সন্তান ও প্রিয়তম। বৈষ্ণব রসের মধ্যে মধুররসই শ্রেষ্ঠ। শাক্ত পদসাহিত্যেও রস পাঁচটি-বাৎসল্য, বীর, অদ্ভুত, দিব্য ও শান্ত। এখানে বাৎসল্যই সব রসের মূল। শাক্ত কবিদের বাৎসল্য সর্বাংশে মানববৃত্তি নির্ভর তা নয়, স্নেহের সঙ্গে এখানে ভয়ঙ্কর উপলব্ধিও জড়িত।


 তবুও জননী সম্বোধনের প্রাণপণ অভীপ্সায় সেই ভয়ঙ্কর রূপ বিগলিত হয়েছে। বৈষ্ণব বাৎসল্যে যশোদার অমূলক আশঙ্কায় শ্রীকৃষ্ণ যে নিতান্তই ঘরের চপল শিশু নয়, এই বিষয়ে একটি অকারণ রহস্যময়তা আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু শাক্ত বাৎসল্যে ও প্রতি বাৎসল্যে মাতার বিশ্বৈশ্বর্য দেখেও কবি মাতৃ নাম উচ্চারণে ও সোহাগ প্রার্থনায় কুন্ঠিত হননি।




 বৈষ্ণব কবি বাৎসল্য থেকে মাথুরে যাত্রা করেন আর শাক্ত কবি বাৎসল্য থেকে শুরু করে সেই বাৎসল্যেই সমাপিত। অবশ্য শেষ পর্যন্ত শাক্ত কবিরা সাধনার দিক থেকে শান্ত রসে এসে আশ্রয়গ্রহণ করেন।


আগমনী-বিজয়ার গানে যে বাৎসল্য রস প্রকাশিত হয়েছে তার সঙ্গে বৈষ্ণব পদাবলীর ‘বাল্যলীলা’র পর্যায়ভুক্ত বাৎসল্য রসের তুলনা করা সম্ভব। সাধক কবি রামপ্রসাদ বৈষ্ণব পদের আদর্শে উমাসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। রামপ্রসাদের কালীকীর্তনে এমন কিছু পদ আছে যেগুলি কৃষ্ণের বাল্যলীলার সাদৃশ্যে রচিত। পটভূমি ও বিষয়গত পার্থক্য হেতু উমার গোষ্ঠলীলা অস্বাভাবিক হলেও রামপ্রসাদ বলেন –




“রানী বলে আমি সাধে সাজাইলাম
বেশ বানাইলাম, উমা, একবার নাচ গো।”


গোষ্ঠলীলার পদে স্বাভাবিক প্রকাশ পেয়েছে বৈষ্ণব পদে। যাদবেন্দ্র রচিত ‘আমার শপতি লাগে না ধাইও ধেনু আগে’ পদটিতে মাতা যশোদা ব্যাকুল কৃষ্ণকে গোষ্ঠে যেতে নিষেধ করেন –‘বনে জাইও না, জাইও না, জাইও না’ –‘তবু যেতে দিতে হয়’। তাই কৃষ্ণ গোষ্ঠ থেকে ফিরে এলে –




“যশোমতি রতন থালি ভরি যতনহি
দেওল বহু উপহার
বিবিধ মিঠাই নবমী দধি ক্ষীর সর
ঝুরি ঝুরি পরম রসাল।”


ঠিক অনুরূপভাবে কৈলাস থেকে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে ক্লান্ত দেহে উমা পিতৃগৃহে উপনীত হয়েছেন। তখন মা মেনকা বলছেন –


“পথশ্রমে স্বেদে সিক্ত কলেবর
ক্ষুধায় মলিন হয়েছে অধর
যত্নে ক্ষীর সর রেখেছি মা ধর
দিব বদন কমলে।”




শচীর স্বপ্নবৃত্তান্তে চিরসন্ন্যাসী নিমাইয়ের মাতৃ-ব্যাকুলতা এবং রাধার স্বপ্ন দর্শনে রাধার কৃষ্ণ মিলনের অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা দুই ভিন্ন ব্যাপার হলেও কমলাকান্ত এই দুই রসের ভাবেই মেনকার স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা চিত্রিত করেছেন পূর্ব – আগমনী - ‘আমি কী হেরিলাম নিশু স্বপনে’ পদটিতে। ঠিক এরকমই স্বপ্ন দেখেছিলেন শচীমাতা-


“ঘরেতে শুইয়াছিলাম অচেতনে বাহির হৈলাম
নিমাইয়ের গলায় সাড়া পাঞা।”


উভয় জাতীয় পদেই ভ্রষ্টস্বপ্নের অপূর্ণ বেদনা পুনর্মিলন বা পুনর্দশনের যে গভীর অপ্রতিরোধনীয় তৃষ্ণা জাগ্রত করে, তারই রেশটুকু কমলাকান্ত সংগ্রহ করে মেনকার স্বপ্নদর্শন ও স্বপ্নভঙ্গে কন্যানিরীক্ষণের গাঢ়তর প্রার্থনায় রূপান্তরিত করেছেন।




নীলাচল থেকে প্রত্যাবৃত্ত নিমাইকে শচীমাতা অশ্রুসিক্ত অভ্যর্থনা জানিয়েছেন –


“দুই হাত তুলি বুকে চুম্ব দিয়া চাঁদ মুখে
কান্দে শচী গলায় ধরিয়া।”


বৈষ্ণব কবি যেমন নিমাই দর্শন আকাঙ্ক্ষায় নদীয়ার পুরনারীদের পথে টেনে এনেছেন, কমলাকান্ত সেইরূপ নগরনন্দিনীদের উমা দর্শনের পথে টেনে এনেছেন –


“আমার উমা এল বলে রানী এলোকেশে ধায়
যত নগর-নাগরী সারি সারি দৌড়ি গৌরী মুখ পানে চায়।”


মেনকার এই উদ্বিগ্ন অভ্যর্থনা দৃশ্য শচীর আনন্দ বেদনাকে অতিক্রম করেছে।




বৈষ্ণব বাৎসল্য রস নিছক লীলারস, পূর্ণ আনন্দের রসপান। এতে বিচ্ছেদ নেই, যন্ত্রণা নেই। গোষ্ঠগমনাদি যেটুকু যন্ত্রণা, তা কেবল মাতৃহৃদয়ের এবং মায়ের প্রাণ ঐরূপ বোধ করবেই। কিন্তু মাতৃভাব এবং অঙ্গাদি বাৎসল্যভাব শাক্তপদের মুখ্য আশ্রয়।


 যখন আগমনী-বিজয়ার গান হয়, তখন গিরিরাজ ও মেনকার মধ্যে স্বয়ং কবি বাসা বাঁধেন, যখন তা মাতৃতত্ত্বের সঙ্গীত হয়, তখন বিশ্বমাতাকে ঘরের মা করে কবি মান-অভিমান, আদর-আবদারে বসেন। আবার বৈষ্ণব বাৎসল্যরস যেখানে বক্তি জীবনের সাধনার ধন, সেখানে সমগ্রজাতীয় জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা শাক্তগীতিকায় প্রস্ফুটিত।




 মেনকা আর কেউ নন বাঙালী মাতা, ঐ গিরিরাজ বাঙালী পিতা। শরৎকাল হতে না হতে মাতৃহৃদয়ের আনন্দাশ্রু আগমনীর আলোয় টলমল করে। বৈষ্ণব পদাবলীর মত এখানে সূক্ষ্ম কলারূপ না থাকতে পারে কিন্তু আছে অতৃপ্ত জীবনের স্পর্শ। দেশকাল নির্বিশেষে নানা বিচিত্র বিধি-বিধানের যূপকাষ্ঠে বলিপ্রদত্ত অসংখ্য কন্যার আর্ত-দীন কন্ঠের সঙ্গে সমীকৃত হয়ে গেছে এই গান।




👉👉   এখানে আমরা শাক্ত ও বৈষ্ণব পদাবলীর বাৎসল্যরসের তুলনা মূলক আলোচনা করেছি। এছাড়া বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সম্পর্কে আমরা এখানে পর পর আলোচনা করেছি প্রয়োজনে এখন থেকে দেখে নিতে পারেন। এখানে ক্লিক করুন।। 

Comments

Popular posts from this blog

MP 2020 History MCQ suggestions, part 6th,

সপ্ত প্রবাহের নীতি। মাধ্যমিক কমিশনের সপ্ত প্রবাহের নীতি।

Four pillars of Education - শিক্ষার চারটি স্তম্ভ | Delors Commission 1997