মুক্তধারা নাটকের নামকরণ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের দ্বিধাবোধ আলোচনা | মুক্তধারা নাটকের নামকরণ
রবীন্দ্রনাথের নাটিমালায় উল্লেখযোগ্য একটি পর্ব হলো রূপক সাংকেতিক ধারা। এই শাখা টি যে সকল শ্রেষ্ঠ নাটকে পরিপুষ্ট তাদের মধ্যে অন্যতম নাটক হলো মুক্তধারা। কিন্তু নাট্যকার এই নাটক রচনার প্রাক্কালে যে নামকরণ করেছিলেন পরবর্তী কলে তার নাম পরিবর্তন করেন। সমালোচকদের ভাষায় এটি একপ্রকার রবীন্দ্রনাথের মতদ্বৈততা, তবুও তার নাম পরিবর্তনের কারণ অযৌক্তিক নয় যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। এখানে মুক্তধারা নাটকের নামকরণ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের দ্বিধাবোধ নিয়ে সামান্য আলোচনা করা হলো -
মুক্তধারা নাটকের নামকরণ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের দ্বিধাবোধ
মুক্তধারা নাটক রচনার প্রাক্কালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রানু অধিকারীকে একটি পত্রে লিখেছিলেন -
" আমি সমস্ত সপ্তাহ ধরে একটা নাটক লিখেছিলুম - শেষ হয়ে গেছে, তাই আজ আমার ছুটি। এ নাটকটি প্রায়শ্চিত্ত নয় এর নাম পথ।"
-- এর থেকে বোঝা যায় তিনি এই নাট্য রচনার প্রথমেই নাটকের নামকরণ ঠিক করে নিয়েছিলেন। তাই যদি ঠিক ছিলো তবে কেনো নাটকের নামকরণ নিয়ে মতদ্বৈততা দেখা দিল !
রবীন্দ্র সাহিত্য পথ শব্দটি নানান অনুষঙ্গে ব্যাবহৃত হয়েছে। পথ সেখানে জীবন পরিক্রমার নামান্তর। যে কবিসত্তা সসীম বস্তু বিশ্বের বাইরে অসীম ভাবাবিশ্বে, সান্ত অবস্থান থেকে অনন্ত অস্তিত্বে আত্মিক মুক্তির সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে চেয়েছে। খুব স্বাভাবিক ভাবে তার সাহিত্যকর্মে পথ গুরুত্বপূর্ন অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে বারবার।
পথ শব্দের নিহিত ব্যঞ্জনা অনন্ত প্রবাহমানতা বা চলমানতার অভিমুখে। একথা সত্য মুক্তধারা নাটকের মূল ভাবনা একটি গতিময়তার দিক কেই ইঙ্গিত করে। কিন্তু এই নাটকের মূল সত্য তার অধিক মাত্রা আমাদের সম্মুখে উন্মোচন করে।
আবার মুক্তধারা নাটকের সমগ্র ঘটনাই সংঘটিত হয়েছে পথে। যুবরাজ অভিজিৎ, রাজা, যন্ত্ররাজ বিভূতি, ধনঞ্জয় বৈরাগী সকলেরই পরস্পরের সাক্ষাত হয়েছে পথে, এমনকি সমস্ত বিষয়টি পরিকল্পিত হয়েছে পথের পরিপ্রেক্ষিতে। তবুও নাট্যকার নাম দিয়েছেন - মুক্তধারা, পথ নয়।
মুক্তধারা শব্দের অর্থ হলো - বন্ধনমুক্ত স্রোতধারা। আবার নাটকের ঝর্নার নাম মুক্তধারা। নাটকের নাটকীয় দ্বন্ধে এই ঝর্নার গুরুত্ব অপরিসীম। নাটকটির রাজশক্তি বনাম কল্যাণবোধের দ্বন্দ্বের বাস্তব পরিণতি মুক্তধারার বাঁধ। অথএব নাটকে মুক্তধারার গুরুত্ব অপরিসীম। সংকীর্ণ প্রদেশিকতার বিরুদ্ধে অসীম প্রাণশক্তির জয়ের বার্তা ঘোষিত হলো মুক্তধারার বাঁধ ভাঙার মধ্য দিয়ে। সুতরাং নামটির মধ্য সংকেতের অভাস লক্ষনীয়।
রূপক সাংকেতিক নাটকে নামকরণ সাংকেতিক ব্যঞ্জনায় পূর্ণতা পায়, সেটাই স্বাভাবিক। বস্তুতপক্ষে মুক্ত জলস্রোতকে প্রকৃতি বিরুদ্ধভাবে বন্ধ করা এবং অভিজিতের আত্মদানের চরমমূল্য তার হারানো গতি ফিরে পাওয়া নিছক গতিপথের পদ্ধতির নির্দেশনায় সীমাবদ্ধ থাকে না। মুক্ত জলস্রোতের প্রাবল্যে অভিজিতের ভেসে যাওয়া ঘটনামাত্র নয়, এখানে সর্ববন্ধন মোচনের এক সংকেত আছে। সুতরাং নাটকের নামকরণ বাচ্যার্থে এবং ব্যঞ্জনাগত দিক দিয়ে মুক্তধারা সুপ্রযুক্ত বলেই নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পথ নামটিকে কে পরিবর্তন করে ছিলেন।
Comments
Post a Comment